পারব।
খুব সাবধান।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
তুমি ওধারে না নামা পর্যন্ত আমি যাচ্ছি না। নেমেই কিন্তু জানিয়ে দেবে।
মিনিট তিনেক বাদে পাঁচিলের ওধার থেকে রণিতার চাপা গলা শোনা যায়, মাসিমা নেমেছি।
বিন্দুবাসিনী আর দাঁড়ান না, ক্রাচের ওপর ভর দিয়ে বাড়িতে এসে সোজা পশ্চিমের ব্যালকনিতে গিয়ে তাঁর হুইল চেয়ারে বসেন।
রণিতা ওপারে নেমে এধারে ওধারে তাকিয়ে নেয়, কেউ কোথাও নেই। চারদিকে অজস্র ফুলের গাছ, মাঝে মাঝে মসৃণ ঘাসের গালিচা। দূরে সামার ভিলার মতো নয়নতারাদের ছবির মতো দোতলা বাড়ি।
কেউ জেগে না থাকলেও বাড়িটার চারপাশে পুরনো আমলের গ্যাস লাইটের আদলে কটা ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলছে। সতর্কতার কারণে সারারাতই ওগুলো জ্বলে।
রণিতা ব্যাগ থেকে ম্যাকিনটশ বার করে একটা গাছের পাশে পেতে তার ওপর বসে পড়ে। মুখ ফিরিয়ে বারো নম্বর বাড়িটার দিকে তাকায়। পশ্চিমের ব্যালকনিতে আবছা সিলুয়েট ছবির মতো দেখাচ্ছে বিন্দুবাসিনীকে। কয়েক পলক দেখেই এবার তার চোখ চলে যায় নয়নতারার বাড়িটার দিকে।
চারপাশে গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে অজস্র জোনাকি জ্বলছে, নিভছে। কোনো অদৃশ্য পাতাল থেকে উঠে আসছে ঝিঁঝিদের একটানা বিলাপ, আলিপুরের এই নিস্তব্ধ ভোরে ছড়িয়ে যাচ্ছে আশ্চর্য বিষাদ। অনেকদিন পর জোনাকি দেখল রণিতা, ঝিঁঝির ডাক শুনল। কলকাতায় এই সব পতঙ্গরা যে এখনও টিকে আছে, এখানে না এলে জানা যেত না।
আকাশ যদিও ঝাপসা, তবু বোঝা যায় মেঘে ঢেকে আছে। যে কোনো মুহর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। কবজি উলটে একবার ইলেকট্রনিক ঘড়িটা দেখে নিল রণিতা, এখনও চারটে বাজেনি, দশ মিনিট বাকি। এই আগস্ট মাসটায় সাড়ে পাঁচটার আগে সকাল হয় না। এখনও দেড়টি ঘন্টা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে বসে থাকতে হবে।
প্রচণ্ড সাহস আর জেদের বশেই এ বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেছে রণিতা। এরপর কোন কৌশলে নয়নতারার কাছে পৌঁছুবে কিংবা পোঁছনোর আগেই তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হবে কিনা সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। রণিতা মোটামুটি এটুকু বুঝতে পারছে, একটা বড় রকমের হার্ডল পেরুতে পেরেছে কিন্তু সামনে আরো কত উঁচু উঁচু বাধা মাথা তুলে রয়েছে, কে জানে। এ বড়িতে ঢোকার পর সে সব ভেবে আর লাভ নেই, যা হবার হবে, এমন একটা বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে সে দিনের আলো ফোঁটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
কিন্তু কয়েক মিনিট কাটতে না কাটতেই রণিতার দুচোখ জুড়ে আসে। বিন্দুবাসিনীদের বাড়িতে সে এসেছিল সাড়ে আটটা নাগাদ। পাঁচিল টপকানোর ..ছকটা আরো নিশ্চিদ্র, আরো নিখুঁত করার জন্য আরেক দফা আলোচনাও করে নিয়েছে। তারপর দশটায় শুয়ে পড়েছিল কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে নি। ভোরে কালোজাম গাছটা থেকে ওধারে নামার সময় ও বাড়ির কারো চোখে পড়ে যাবে কিনা, পড়লে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, এই টেনসানে তার স্নায়ু টান টান হয়ে ছিল। এমন মানসিক চাপ নিয়ে ঘুমনো যায় না। পাচিল ডিভোবার পর এখন স্নায়ুগুলো আলগা হয়ে হয়ে শরীরে প্রচণ্ড ক্লান্তি নেমে এসেছে।
হঠাৎ বৃষ্টি নামতে ঘুম ছুটে যায়। আকাশ থেকে সীসার ফলার মতো নেমে আসা বড় বড় জলের ফোঁটাগুলো তার সারা গা ভিজিয়ে দিয়েছে। ধড়মড় করে উঠে ম্যাকিনটশটা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিজেকে মুড়ে ফেলে রণিতা।
বৃষ্টিটা যেমন আচমকা নেমেছিল তেমনি মিনিট দশ পনেরো বাদে হঠাৎই থেমে গেল। শরঙ্কালের বৃষ্টির চালটাই এরকম, কখন নামবে কখন থামবে আগে থেকে বলা মুশকিল।
যে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল, রণিতার চোখের পাতায় ফের সেটা ফিরে আসে। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমের আরকে সে ডুবে যায়।
কতক্ষণ পর রণিতা জনেনা একটা কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসেআসে,মেমসাব, এ মেমসাব– প্রথমে আবছা, তারপর ধীরে ধীরে ডাকটা স্পষ্ট হতে থাকে।
চোখ মেলেই চমকে ওঠে রণিতা, একটা মঙ্গোলিয়ান মুখ তার ওপর ঝুঁকে আছে। মুখটা তার চেনা কিন্তু আগে কোথায় দেখেছে, মনে পড়ল না। তেমনি ভেবে পেল না এই বাগানটার ভেতর সে এল কী করে?
কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের ভেতর ঘুমের রেশটা পুরোপুরি কেটে গেলে সব মনে পড়ে যায় রণিতার। মঙ্গোলিয়ান মুখটা দেখেছে এ বাড়ির গেটের একটা চৌকো ফোকরে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে সে এখানে এসেছে সে ব্যাপারে কিছু করার আগেই দারোয়ানের কাছে ধরা পড়ে গেছে। এমনিতে রণিতা খুবই সাহসী, কিছুটা বেপরোয়া ধরনের, কোনো বিপজ্জনক অবস্থাতেই সে বিহ্বল বা দিশেহারা হয়ে পড়ে না। মনের জোর তার অপরিসীম। কিন্তু এই মুহূর্তে রণিতার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরন খেলে যায়। সেটা কি ভয়ে?
ভেতরে ভেতরে সে যে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল সেটা অবশ্য বাইরে বেরিয়ে আসতে দেয় না। রণিতা জানে তার এতটুকু দুর্বলতা দেখলে দারোয়ানটা গোলমাল শুরু করে দেবে। কোনোভাবেই মাথায় ওকে চড়তে দেওয়া যায় না। প্রবল ব্যক্তিতে তাকে দমিয়ে রাখতেই হবে।
ধীরে ধীরে গা থেকে ম্যাকিনটশটা খুলে ভাঁজ করে ব্যাগের ভেতর পুরতে থাকে রণিতা।
রোদ উঠে গিয়েছিল। গলানন গিনির মতো শরতের মায়াবী আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। কাল আকাশ জুড়ে যে ঘন কালো মেঘ ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই, জোরালো একগুয়ে হাওয়া ঠেলে ঠেলে তাদের দিগন্ত পার করে দিয়েছে। আকাশটা আজ পালিশ-করা আয়নার মতো ঝকঝকে।