রণজয় হাসিমুখে রণিতাদের বসিয়ে বললেন, বলুন মিস মিত্র, আপনাদের জন্য কী করতে পারি–
এখানে আসার কারণটা জানিয়ে দেয় রণিতা।
রণজয় রীতিমত উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন, নয়নতারাকে নিয়ে ছবি করবেন। দারুণ ব্যাপার। জানেন আমি ওঁর অন্ধ ভক্ত। কিন্তু ম্যাডাম–
রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী?
রণজয় বলেন, ওঁর সম্বন্ধে আমাদের কাছে কোনো ইনফরমেশন নেই।
খুব অবাক হয়ে যায় রণিতা। বলে, এত বড় একজন আর্টিস্ট, আট বছর তিনি নিরুদ্দেশ, অথচ আপনারা তাঁর খবর রাখেন না! স্ট্রেঞ্জ।
দেখুন, নয়নতারার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ এসে আমাদের বলেননি, ওঁকে খুঁজে বার করে দিন।
তাই আপনারা কিছু করেননি! ন্যাশনাল ইন্টারেস্টেও ওঁর খোঁজ করা উচিত ছিল।
তক্ষুণি উত্তর দেন না রণজয়। বেশ কিছুক্ষণ পর বলেন, যিনি নিজের থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন, চেনাজানা কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে চান না, তাঁর পেছনে গোয়েন্দা লাগানোটা কি ঠিক?
এদিকটা ভেবে দেখেনি রণিতা। সে চুপ করে থাকে। রণজয় বলেন, তা ছাড়া আরেকটা ব্যাপারও চিন্তা করা দরকার।
উৎসুক চোখে তাকায় রণিতা।
রণজয় থামেন নি, প্রত্যেক মানুষের একটা প্রাইভেট লাইফ আছে। সোসাইটির কারো কোনো ক্ষতি না করে নিজের পছন্দমতো কেউ যদি লাইফ কাটাতে চান, কেন তাঁকে আমরা ডিসটার্ব করব? কারো ব্যক্তিগত জীবনে ইন্টারফেয়ার করাটা শুধু অনুচিতই নয়, অন্যায়ও।
এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল অমিতেশ। এবার সে বলে ওঠে, কিন্তু—
তার দিকে মুখ ফিরিয়ে রণজয় বলেন, কিন্তু কী?
নয়নতারা খুব সাধারণ সিটিজেন নন, তিনি বিরাট পাবলিক ফিগার। আমাদের কালচারাল ওয়ার্ল্ডে তাঁর কনট্রিবিউশানের তুলনা নেই। দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর সম্মান তিনি নিয়ে এসেছেন। ভারতবর্ষ তাঁর জন্য গর্বিত। এমন একজন আউটস্ট্যান্ডিং পার্সোনালিটির আট বছর কোনো খোঁজ নেই, অন্য দেশ হলে কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকত না।
অমিতেশের কথাগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম শ্লেষ ছিল। রণজয় কিন্তু অসন্তুষ্ট হন না, আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, পুলিশের দিক থেকে না হলেও তাঁর অনুরাগী হিসেবে আমাদের সবারই ওঁর খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।
বণিতা সোজা কাজের কথায় চলে আসে, আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে আপনি শুনবেন।
রণজয় উৎসুক চোখে রণিতার দিকে তাকান।
রণিতা বলে, এতদিন কেউ বলেনি, তাই আপনারাও কিছু করেননি। আমাদের বিশেষ অনুরোধ, ওঁর এখনকার ঠিকানাটা জোগাড় করে দিন।
রণজয় চুপ করে থাকেন। মনস্থির করতে হয়তো তাঁর খানিকটা সময় লাগে। তারপর বলেন, পুলিশ খোঁজাখুঁজি করছে, জানতে পারলে উনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হবেন। যতটা সম্ভব গোপনে কাজটা করতে হবে। ঠিক আছে, আপনারা এত বড় একটা প্রোজেক্টে হাত দিতে চলেছেন, সে জন্য এই রিস্কটুকু নেব।
আরেকটা কথা—
বলুন।
ঠিকানাটা যদি সত্যি সত্যিই পাওয়া যায়, প্লিজ অন্য কাউকে জানাবেন না। মিডিয়ার লোকেরা টের পেলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাদের প্রোজেক্টটাই তখন ভেস্তে যেতে পারে। আমরা চাই এক্সকুসিভলি কাজটা করতে।
রণজয় হাসেন, ঠিক আছে। ঠিকানাটা পাওয়া গেলে আপনারা ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
অনেক, অনেক ধন্যবাদ মিস্টার সেন। আমরা কিন্তু মাঝে মাঝে ঠিকানাটার জন্য ফোন করে বিরক্ত করব।
বিরক্ত কী! ইটস আ প্লেজার। আপনাদের ফোন নাম্বার দিয়ে যান। হঠাৎ যদি নয়নতারার খোঁজ পেয়ে যাই আমিও যোগাযোগ করব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
০৬-১০. পরদিন সন্ধেবেলা
পরদিন সন্ধেবেলা চেতলায় মণিময় চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করতে গেল রণিতা আর অমিতেশ। মৃণালেরও আসার কথা ছিল কিন্তু আসানসোলে দুই পলিটিক্যাল পাটির ওয়াকারদের মধ্যে প্রচণ্ড মারদাঙ্গা বাধায় চারজন খুন হয়েছে। চিফ রিপোর্টার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে তাকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাত দশটার আগে তার ফেরার সম্ভাবনা নেই।
মণিময়দের দোতলা বাড়িটা বড় না হলেও বেশ ছিমছাম। সামনে পেছনে ছোট্ট বাগানও রয়েছে। বাগান পেরিয়ে পাঁচটা সিঁড়ি ভেঙে বাইরের বারান্দায় উঠে কলিং বেল টিপতেই একটি কাজের লোক একতলার ড্রইং রুমে রণিতাদের পোঁছে দেয়।
বসার এই ঘরটা সোফা, সেন্টার টেবল, ডিভান, বুক-কেস, ওয়াল ক্লক, এয়ারলাইনসের সুদৃশ্য ক্যালেন্ডার আর পেতলের চকচকে নটরাজ দিয়ে সাজানো। ডিভানে বালিশের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া মতো হয়ে ছিলেন মণিময়। রণিতাদের দেখে আস্তে আস্তে উঠে বসেন। মৃণালের বন্ধু হিসেবে অমিতেশকে তিনি চেনেন। বলেন, তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি অমিত। এই বুঝি রণিতা?
হ্যাঁ বড়মামা–মৃণালের দেখাদেখি অমিতেশও মণিময়কে বড়মামা বলে।
বসো, বসো–
অমিতেশ আর রণিতা মণিময়কে প্রণাম করে সোফায় বসে।
যদিও সত্তরের কাছাকাছি বয়স এবং একটা বড় ধরনের স্ট্রোক হয়ে গেছে তবু মণিময়কে এখনও সুপুরুষ বলা যায়। গড় বাঙালির তুলনায় তাঁর হাইট বেশ ভাল, ছ ফিটের মতো। চুলের বেশির ভাগই কালো। চওড়া কপাল, ভারি চোয়াল, ধারালো নাক। এই বয়সেও চোখে ছানি পড়ে নি, দৃষ্টি উজ্জ্বল এবং গভীর। তাঁর পরনে ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি।
কাজের সেই লোকটি একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে অমিতেশদের জন্য চা আর মিষ্টি টিষ্টি আনতে বলে রণিতার দিকে তাকান মণিময়, তোমার কথা টাবু আমাকে সব জানিয়েছে।