আরও একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি। আমার নিজের পরিবার থেকে। আমার বাবা একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রধান শিক্ষক হিশেবে তাকে সবচেয়ে সফল গ্রামের স্কুলে পরিণত করেন। ১৯৬০-এর দশকে। ফি বছর সে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নাম থাকতো মেধা তালিকায়। কিন্তু আমার বাবাকে তাঁর বাবা লেখাপড়া শেখাতে চাননি এবং বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন বলে তাঁকে নিজে কষ্ট করে মানুষ হতে হয়েছিলো। তিনি গর্ব করে বলতেন, তিনি দোকানদারের সহকারী হিশেবে কাজ করেছেন। অন্যের নারকেল পেড়ে দিয়ে জীবিকা উপার্জন করেছেন এবং স্কুলের বেতন দিয়েছেন। অর্থাৎ দু বেলা খাওয়া, পরা এবং লেখাপড়ার জন্যে রীতিমতো সংগ্ৰাম করেছিলেন। তারপর নিজে শিক্ষিত হয়ে, তিনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন সমগ্র এলাকায়। সংক্ষেপে, তিনি চাষী পরিবারের সন্তান হলেও নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছিলেন এবং অন্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি স্বগঠিত মানুষ। তাঁর এ রকমের পরিচিতি দিয়ে আমি একটি প্রবন্ধ লিখি তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। যাতে তারা তার কথা জানতে পারে। বড়ো হওয়ার জন্যে উৎসাহ পায়। কিন্তু তাতে আমার একেবারে আপনজনেরা দারুণ ক্ষুদ্ধ এবং ক্রুদ্ধ হন। আমার প্রতি। কারণ, আমার বাবাকে আমি খান বাহাদুর হিশেবে চিত্রিত করলাম না কেন? তিনি যখন অতো সফল মানুষ, তখন তার চোদ্দো পুরুষ সফল হবে না কেন?
বেশির ভাগ বাঙালির মনোভাবই এ রকম। ভালো হলে তার কোনো সীমা থাকবে না। আবার খারাপ হলেও তা সীমা ছাড়িয়ে যাবে। যেমন, কেউ একটা বিষয় ভালো করে জানে না–এ কথা বোঝানোর জন্যে তারা বলেন: “ও কী জানে!” কেউ অগ্ৰীতিকর কিছু করে থাকলে, তার সম্পর্কে বলেন: “ওর মতো বদমাশ হয় না।” (আসলে অতো ভদ্র ভাষায় নয়, একটা গাল দিয়ে বলেন। সেটা স্ত্রীর ভ্রাতাসূচক হতে পারে; এমন কি, কারো পিতৃপরিচয় ঠিক নেই, তেমন ইঙ্গিতপূর্ণও হতে পারে।) কেউ ভালো মানুষ বোঝাতে হলে, তারা বলেন, “তাঁর মতো ভালো মানুষ হয় না।” অথবা “অমুক ব্যক্তি দেবতার মতো।” (দেবতাদের যে-গল্প পড়ি, তাতে তাদের মতো হলে, তাকে ভালো মানুষ বলা যায়। কিনা, সেটা বিবেচনা করার বিষয়। উল্টো, মনে হয় দেবতাদেরই ভালো মানুষের মতো হওয়া উচিত ) মোট কথা, বাঙালিদের চোখে সব কিছুই হয় উত্তম, নয়তো অধম। মাঝারি বলে কিছু নেই।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে কর্তাভজা নামে একটি সম্প্রদায় বঙ্গদেশের একটা অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। এখন সেই সম্প্রদায় প্রায় লুপ্ত হয়েছে, কিন্তু নানা নামে আমরা এখনও কর্তর ভজনা করি, কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করি। যিনি যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারই পদসেবা করি। তাঁর অন্ধ প্ৰশংসায় কেবল পঞ্চমুখ নয়, রাবণের মতো দশমুখ হই। তাঁর আগে যিনি ক্ষমতায় ছিলেন তিনি তখন নিকষ-কালো ভিলেনে পরিণত হন। সাধারণ সৌজন্যও দেখাই না তাঁর প্রতি। বস্তুত, কর্তাদের সম্পর্কে আমাদের প্রশংসা এবং বিনয় প্রায় অতলান্তি সমুদ্রের মতো। কর্তা মা-বাপ, আর আমরা সবাই …-এর বাচ্চা।
বাঙালিদের গোষ্ঠীকেন্দ্ৰিক মনোভাবেও এই শাদা-কালোর মনোভাবকে আরও জোরদার করেছে। বেশির ভাগ বাঙালির কাছে আত্মীয়রা ধোয়া তুলসি পাতার মতো, শতকরা এক শো ভাগ পূত-পবিত্র, শাদার শাদা। অপর পক্ষে, আত্মীয়ের প্রতিপক্ষে যে-অনাত্মীয় আছেন, তাঁর মতো খারাপ মানুষ ভূভারতে নেই। কিন্তু আমি আত্মীয় বলে কাউকে খোলা চেক দিতে রাজি না, পারিও না। কারণ, আমার বিবেচনায়, আমার আত্মীয়দের কেউ কেউ ভালো, বেশির ভাগ মাঝারি। আর দু-একজন নিকৃষ্ট মানুষ। দুপায়ে হাঁটলেও অন্য জন্তুদের সঙ্গে এই শেষ শ্রেণীর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এভাবে দেখলে জগৎ এবং জীবনকে মোটামুটি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়েছে বলে তার মধ্যে কোনো খাদ থাকতেই পারে না; আর আবু জাফর গান রচনা করে থাকলে–ও আবার কী লিখবে–আগে থেকে এ ধারণা করা ঠিক নয়। বস্তুত, জগৎ এবং জীবনকে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে সঠিকভাবে দেখতে হলে ঐ মাঝারি–ঐ ধূসর রঙটা ভালো করে দেখার ক্ষমতা দরকার। আমাদের চরিত্রেই সেই ক্ষমতারই অভাব।
(যুগান্তর, ২০০৬)
৩০. প্রেমের প্রাদুর্ভাব ও প্রতিকার
প্ৰস্তাবনা
ভালোবাসা নামক রোগে আক্রান্ত হয়েন নাই, এমন ব্যক্তি ত্ৰিভুবনে আছেন। কিনা, তাহা লইয়া বিতর্ক থাকিলেও থাকিতে পারে; কিন্তু ইহা যে সুমরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত সমস্ত বিশ্বের আকাশে, বাতাসে, অন্তরীক্ষে ইথার তরঙ্গের মতো বিচরণ করিয়া বেড়াইতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। মহাশূন্যেও বিচরণ করিতেছে কিনা, তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তবে অসম্ভব নহে। ইহার ফাদ সর্বত্র পাতা আছে–কে কোথায় ধরা পড়ে, কেহই জানে না। সৌভাগ্যক্রমে শিশু এবং বৃদ্ধ — যাহাদের রোগ প্রতিরোধক শক্তি সীমিত, তাহারা সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হয় না। তবে ভীমরতি নামক উপব্যাধি থাকিলে বৃদ্ধরও এই পীড়ার শিকার হইতে পারেন। এবং বার্ধক্যে এই রোগ দেখা দিলে বেশি বয়সের হাম রোগের আক্রমণের মতো–তাহা নিদারুণ হইয়া থাকে। মোট কথা, এই ভয়ানক ব্যায়রাম বিশ্বের আনাচে-কানাচে মহামারীর আকারে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রেই তাহা স্বীকার করিবেন। ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্ৰজা, সিনেটর-প্রেসিডেন্ট, ক্রেতা-বিক্রেতা, মেথরমুচি–কেহই ইহার আকস্মিক হামলা হইতে রেহাই পাইয়াছেন বলিয়া শুনি নাই। পাইলে নিশ্চয় গিনিস বুক অব রেকর্ডসে তাহার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকিত।