আধুনিক কালে ঘরের কাজ নিয়ে স্বামীস্ত্রীর দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে দানা বেঁধেছে, বিশেষ করে পশ্চিমা জগতে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীশ্ৰী দুজনই চাকরি করেন। তেমন অবস্থায় রান্না করবেন কে? ঘরের আর-পাঁচটা কাজ করবেন কে? সন্তান লালনপালন করবেন কে? পুরুষরা এসব দায়িত্ব সহজে স্বীকার করে নেননি, এখনো সহজে স্বীকার করেন না। এখনো বহু পরিবারে মহিলারাই ঘরের কাজ পুরোপুরি করেন। অথবা বেশির ভাগ করেন। কিন্তু সংসারের শান্তি বজায় রাখার জন্যে পুরুষরা একটাদুটো করে এসব কাজে মহিলাদের সাহায্য করতে আরম্ভ করেছেন। এখন পশ্চিমা জগতে বহু পরিবারেই রান্নার খানিকটা স্বামীরা করেন। এমন কি, এ রকম পরিবারও আছে যেখানে রান্নার পুরো দায়িত্বই স্বামীদের।
বাংলাদেশে অথবা পশ্চিম বঙ্গে নারীদের অধিকার আদায় করার জন্যে এবং সে সম্পর্কে সচেতনতা জাগিয়ে তোলার জন্যে যে-নারীরা লড়াই করছেন, তারা এখনো রান্নার কাজে সহায়তা করার জন্যে স্বামীদের ডাক দেননি। তার কারণ এই যে, এ অঞ্চলে রান্নার কাজ গৃহিণীরা নিজেরাই কম করেন, অথবা আন্দীে করেন না–এখনো কাজের লোক পাওয়া যায় বলে। কিন্তু যখন কাজের লোক পাওয়া যাবে না, তখন যে এই প্রশ্ন নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিতর্ক এবং বিরোধ দেখা দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। এবং কে কী কাজ করবেন তা নিয়ে সংসারে সংসারে যে মন কষাকষি চলবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। সেই দ্বন্দ্বের শেষে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকা কী দাঁড়াবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে ঘরের কাজ নারীবাদের একটা প্রধান প্রশ্ন।
নারীবাদের আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিবারের আয়তন। পুরুষরা স্ত্রীর গর্ভ সঞ্চার করেই খালাস। কিন্তু স্ত্রীদের সেই সন্তান দীর্ঘ ন মাস গৰ্ভে ধারণ করতে হয়। এবং সন্তান জন্মের পরও মাকেই সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব নিতে হয়। সন্তান মানুষ করা মোটেই সহজ কাজ নয়। তা সত্ত্বেও এখনো বহু সমাজে মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের গর্ভ ধারণ করতে বাধ্য করা হয়। নারীবাদীদের মতে, গৰ্ভ ধারণ করা অথবা না-করার অধিকার থাকা উচিত পুরোপুরি নারীদের। এই জন্যে পশ্চিমা জগতে সন্তানসংখ্যা সীমিত রাখার যে-সচেতনতা দেখা দেয়, তা থেকেই শুরু হয় গর্ভপাতের আইন প্রণয়ন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল আবিষ্কারের গবেষণা। কিন্তু সেখানে প্রধান বাধা আসে ধর্মের তরফ থেকে। ক্যাথলিকরা কোনো রকম জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করেন না। গর্ভপাতের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমন কি, পিল খাওয়াতেও নয়। সংযম পালনই তাদের জন্যে একমাত্র ব্যবস্থা। বলা বাহুল্য, এটা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা অথবা যুক্তির কথা নয়।
তাই নারীবাদীদের একটা গোষ্ঠী নারীদের গর্ভপাত এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্যে সংগ্রাম করেন। বিশেষ করে ধর্ষিতা মহিলারা গর্ভবতী হলে অবশ্যই তাঁদের গর্ভপাতের অধিকার থাকা উচিত বলে তাঁরা দাবী করেন। তাঁদের এই দাবির মুখে বিশ শতাব্দীতে গর্ভপাতের অধিকার অনেক দেশেই স্বীকৃত হয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রযুক্তিতে উন্নত কিন্তু মনোভাবের দিক দিয়ে মৌলবাদী দেশের একাংশ এখন গর্ভপাতের বিরুদ্ধে রীতিমতো সহিংস আন্দোলন করছে। যারা গর্ভপাত করান তেমন ডাক্তারদের পর্যন্ত তারা হত্যা করেছে অথবা ভয়ভীতি দেখিয়েছে। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে এই অধিকার বহাল রাখার জন্যে নারীবাদীরা জেহাদী মনোভাব দেখাচ্ছেন। এ ব্যাপারে নারীবাদীদের একাংশ এমনই কট্টরবাদী যে, অনেকে তাদের বলেন ফেমিনাৎসি—অর্থাৎ নারীবাদের নাৎসি। জঙ্গী নারীবাদী। এ শব্দটি প্রথম বারের মতো ব্যবহৃত হয় ১৯৯০ সালে।
তবে স্বীকার করতে হবে আন্দোলন ছাড়াই ১৯৬০ সাল থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল বাজারে বের হওয়ার পর থেকে পশ্চিমে সন্তানের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। অরক্ষিত যৌনকর্মের পরের দিন সকালে পিল খেয়ে গর্ভনিরোধের ওষুধও আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে কার্যকরভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এখন আছে। তা ছাড়া, অনেক পরিবারে স্বামীশ্ৰী আগে থেকেই সন্তান না-নেওয়ার সংকল্প করেন। তারা মনে করেন। যে, সন্তান নিলে জীবন উপভোগ করার সুযোগ অনেক কমে যাবে। কর্মজীবী বহু মহিলা আবার মনে করেন যে, সন্তান নিলে কর্মস্থানে উন্নতির প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়বেন। এই সমস্ত কারণে পশ্চিমা জগতে কোনো কোনো দেশে জন্মের হার এতো কমে গেছে যে, সেসব দেশে মোট জনসংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বলা যেতে পারে, এসব দেশে গর্ভপাতের যে-অধিকার রয়েছে, তা নীতিগত অধিকার, বাস্তবে তার প্রয়োগ অতো ব্যাপক নয়।
অনেক পুরুষসমাজেই দেখা যায় যে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে অংশত নারীদেরই দায়ী করা হয়। ধর্ষিতা নারী কী ধরনের পোশাক পরেছিলেন এবং সাজগোজ করেছিলেন, কেমন আচরণ করেছিলেন, ধর্ষককে যদ্দুর সম্ভব শারীরিকভাবে বাধা দিয়েছিলেন। কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু ধর্ষণ করার দায় যে পুরুষের সেটা এক কথায় স্বীকার করে না। ধর্ষিতা নারীকেই প্রমাণ করতে হয় যে, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ভারতে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর চার লাখের বেশি। ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এই সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আংশিকভাবে নারীদেরই দায়ী করেছে। তাদের বক্তব্য হলো মেয়েরা ধর্ষণের আগে অনেক ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় পোশাক পরেছিলেন এবং উস্কানিমূলক আচরণ করেছিলেন।