ফায়সাল বলল, শত্রুতা মিটিয়ে মিত্ৰতা করা যায় না?
ফায়জুন্নেসা রেগে উঠে বললেন, সেটা আমাদের ব্যাপার আমরা দেখব, আপনি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না।
কিন্তু মানুষের সঙ্গে শত্রুতা জিইয়ে রাখা উচিত নয়। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য তো নয়ই। হাদিসে আছে, আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “হে মুসলমানগণ আমার পরে তোমরা কাফেরদের কার্যকলাপে লিপ্ত হইও না যে, তোমরা একে অপরকে হত্যা করতে আরম্ভ কর।”
আর আল্লাহ কুরআন পাকে বলিয়াছেন, “আর যদি মুসলমানদের দুই দল পরস্পর (ঝগড়া-বিবাদ) যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া পড়ে, তবে তাহাদের মধ্যে মীমাংসা ও পুনর্মিলন করিয়া দাও, অনন্তর যদি তাহাদের এক দল অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তবে সেই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর-যেই দল বাড়াবাড়ি করে যে পর্যন্ত না তাহারা আল্লাহর আদেশের দিকে ফিরিয়া আসে, অতঃপর যদি তাহারা প্রত্যাবর্তিত হয়, তবে উভয়ের মধ্যে ন্যায়ের সহিত সন্ধি করাইয়া দাও; আর সুবিচারের প্রতি লক্ষ্য রাখিও; নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বানদিগকে পছন্দ করেন।”
এখন আপনিই বলুন, মুসলমানদের মধ্যে কি শত্রুতা থাকা উচিত?
কুরআন হাদিসের কথা শুনে ফায়জুন্নেসা আরো রেগে ওঠে বললেন, মনে রাখবেন, আমার এখানে আপনি চাকরি করতে এসেছেন, ওয়াজ করার জন্য। নয়। আর কখনও যদি এসব ব্যাপার নিয়ে বলেন, তা হলে…..বলে রাগে কথাটা শেষ করতে পারলেন না।
ফায়সাল ওনার রাগকে গ্রাহ্য করল না। মৃদু হেসে বলল, একজন মানুষ জেনে অথবা না জেনে যদি ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়, তা হলে অন্য মানুষের উচিত তাকে বাধা দেয়া। যদি না দেয়, তা হলে সে মানুষই না। সে ব্যাপারেও আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আর তোমাদের মধ্যে এমন একদল এইরূপ থাকা আবশ্যক, যেন তাহারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে এবং নেক কাজের আদেশ করিতে ও মন্দ কাজের বারণ করিতে থাকে, আর এইরূপ লোক পূর্ণ সফলকাম।”
একজন মুসলমান হয়ে যদি কুরআনের আদেশ না মানি, তা হলে কাল হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে মুখ দেখাব কি করে?
ফায়েজুন্নেসা ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। হাসেমকে ইশারায় কিছু বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।
হাসেম রাগের সঙ্গে ফায়সালকে বলল, এই যে ম্যানেজার সাহেব, মালেকিন নিষেধ করা সত্ত্বেও ওয়াজ করছেন কেন? আর কখনও করলে কল্লা মটকে দেব। এবার মালেকিন যে চেয়ারে বসেছিলেন ওখানে গিয়ে বসুন। একটু পরে মৃণালবাবু এসে আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন। কথা শেষ করে হাসেম চলে গেল।
.
আজ চারমাস ফায়সাল এখানে কাজ করছে। এর মধ্যে চৌধুরী স্টেটের সবকিছু দেখেছে, সাজ্জাদের কাছে লাঠিখেলায় পারদর্শী হয়েছে, কয়েকদিন আগে একটা রিভলবারও পেয়েছে। অফিসের কাজ সকাল নটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত করে। বিকেলে সাজ্জাদকে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে বেরোয়।
সাজ্জাদের বয়স পঁয়ত্রিশের মতো। লেখাপড়া তেমন জানে না। তার বাবা লেঠেলদের সর্দার ছিল। ছেলে সাজ্জাদকে লাঠিখেলায় দক্ষ করেছে।
সাজ্জাদের বাবাও চৌধুরী বাড়িতে চাকরি করত। বাবা মারা যাওয়ার পর সাজ্জাদকে ইনসান চৌধুরী চাকরি দেন। ফায়সাল কৌশলে সাজ্জাদকে হাত করে চৌধুরী বাড়ির অনেক খবর জেনেছে। ফায়জুন্নেসার মা লুৎফা বেগম বেঁচে আছেন। তার কাছেই জানার পর ওনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু কিভাবে করবে চিন্তা করে ঠিক করতে পারছে না। আরো জেনেছে পাশের গ্রামের আজিজ কয়েক বছর এই স্টেটের ম্যানেজার ছিল। মালেকিন তাকে বরখাস্থ করার পর থেকে সে শত্রুতা করে আসছে। মাঝে মাঝে চৌধুরী স্টেটের জমির ফসল লুট করতে আসে লেঠেল বাহিনী নিয়ে। সে সময় উভয় বাহিনীর সঙ্গে মারামারি হয়। উভয় বাহিনীর অনেকে হতাহত হয়।
ফায়সাল সিদ্ধান্ত নিল যেমন করে হোক শত্রুতার অবসান ঘটাতে হবে। তার আগে এ বাড়ির সবাইকে ধর্মের পথে আনতে হবে। ছ’মাসের মধ্যে মৃণালবাবু ছাড়া অফিসের সব স্টাফকে ও বাড়ির সব চাকর-চাকরানি এমন কি হাসেমকে পর্যন্ত কুরআন-হাদিসের বাণী শুনিয়ে ধর্মের পথে আনতে সক্ষম হল। এখন সবাই তাকে পীরের মতো মানে।
ফায়জুন্নেসা মাঝে মধ্যে যখন মৃণালবাবুর কাছে ফায়সালের কাজ কর্মের খোঁজ নেন তখন মৃণালবাবু ফায়সালের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ওনার আগে এত ভালো ছেলে কেউ ম্যানেজার হয়ে আসে নি।
কুলসুম ফায়জুন্নেসার বিশ্বস্ত চাকরানি। তাকে সব সময় মাথায় কাপড় দিতে দেখে একদিন ফায়জুন্নেসা জিজ্ঞেস করলেন, মাথায় কাপড় দিয়ে থাকিস কেন?
কুলসুম বলল, মেয়েদের মাথায় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা ইসলামের হুকুম।
অবাক হয়ে ফায়জুন্নেসা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ইসলামের হুকুমের কথা তোকে কে বলেছে?
ম্যানেজার সাহেব বলেছেন। শুধু আমাকে নয়, এ বাড়ির সব চাকর চাকরানিদেরকে ইসলামের কথা বলে সে সব মেনে চালাবার চেষ্টা করছেন।
ঠিক আছে, হাসেমকে আমার কাছে আসতে বল।
একটু পরে হাসেম এসে বলল, ডেকেছেন মালেকিন?
হ্যাঁ, গুনলাম ম্যানেজার নাকি তোদের সবাইকে ধার্মিক বানাবার চেষ্টা করছেন?
আপনি ঠিকই শুনেছেন। এতদিন আমরা ধর্মের কোনো কিছুই জানতামও না মানতামও না। ম্যানেজার সাহেবের কাছে সেসব জেনে আমরা মেনে চলছি। আমার কি মনে হয় জানেন মালেকিন, ম্যানেজার সাহেব আল্লাহর একজন খাস বান্দা। সাজ্জাদের কাছে শুনলাম, কয়েকদিন আগে ম্যানেজার সাহেব পাশের গ্রামে গিয়েছিলেন। সে কথা আজিজ সাহেব জানতে পেরে গুণ্ডা বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন। উনি তাদের সঙ্গে লড়াই করে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসেন। আপনিই বলুন, আল্লাহর খাস বান্দা না হলে কি এটা সম্ভব হত?