খাবারের মেনু দেখে ফায়সালের মনেই হল না, অজপাড়াগাঁয়ে এসেছে। খাওয়া শেষ হতে মেয়েটি যখন থালা বাটি গুচ্ছাছিল তখন জিজ্ঞেস করল, এখানে কতদিন কাজ করছেন?
কাজের মেয়েদেরকে কেউ আপনি করে বলে না। নতুন ম্যানেজারকে বলতে শুনে মেয়েটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।
কি হল? আমার কথার জবাব দিলেন না যে?
মেয়েটি মুখ নিচু করে বলল, আমার জন্ম এখানেই?
তারমানে আপনার মাও এখানে কাজ করতেন?
মেয়েটি শুধু মাথা নাড়াল।
আর আপনার সঙ্গে যিনি এসেছিলেন?
আমার মতো ওরও জন্ম এখানে?
কি নাম আপনার?
আকলিমা।
নাম শুনে ফায়সাল অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার এক খালার নাম আকলিমা। উনি মারা গেছেন। আমি আপনাকে খালাম্মা বলে ডাকব।
আঁৎকে উঠে আকলিমা বলল, না-না, অমন কাজ করবেন না। মালেকিন জানলে আমাকে আস্ত রাখবেন না বলে ত্রস্তপদে চলে গেল।
ফায়সাল বুঝতে পারল, ফায়জুন্নেসা খুব কড়া মহিলা। চাকর চাকরানিরা ওনাকে ভীষণ ভয় পায়।
পরের দিন সকালে আকলিমা নাস্তা নিয়ে এল না, অন্য মেয়েটি নিয়ে এল।
ফায়সাল জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কি?
এই মেয়েটির নাম তাসলিমা। নাম না বলে বলল, দেখুন আমরা বাড়ির চাকরানি। আমাদেরকে আপনি করে বলবেন না, কোনো কিছু জিজ্ঞেসও করবেন না। আকলিমা বোকা। তাই কাল সে ভুল করলেও আমি করব না।
ফায়সাল বুঝতে পারল, এরা চাকরানী হলেও শিক্ষিতা। বলল, আমার তো মনে হয়, আকলিমা খালাম্মা কোনো ভুল করেন নি। আর আমি তো ছোট বড় সবাইকেই আপনি করে বলি।
সবাইকে বললেও আমাদেরকে বলবেন না। মালেকিন জানতে পারলে আপনার বিপদ হবে।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, বিপদ হোক, তবু সবাইকেই আপনি করে বলব।
তাসলিমা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। ফায়সালের নাস্তা খাওয়া শেষ হতে বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেল।
চৌধুরী বাড়ির সব থেকে পুরানো চাকর হাসেম। বয়স ষাটের উপর। লম্বা চওড়া পেটাই শরীর, গায়ের রঙ শ্যামলা। এত বয়স হয়েছে, দেখলে মনে হয় না। দু’চারজন যুবক তার কাছে কিছুই না। লাঠি খেলায় ও শুটিংএ পারদর্শী। তার কাছে সব সময় একটা রিভলবার থাকে। তবে সে কথা লুৎফা বেগম ও ফায়জুন্নেসা ছাড়া কেউ জানে না। সে হল চাকর-চাকরানিদের সর্দার।
নাস্তা খেয়ে ফায়সাল পাজামা পাঞ্জাবি পরে বসে বসে ভাবছিল, এখানে তাকে কি কাজ করতে হবে। কি জন্যে আগের ম্যানেজার খুন হলেন? এমন সময় হাসেম এসে বলল, চলুন, মালেকিন ডাকছেন।
ফায়সাল তার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারল, এই লোক ঠাণ্ডা মাথায় যে কোনো লোককে খুন করতে পারে। সালাম দিয়ে বলল, আপনার পরিচয়?
হাসেম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমার পরিচয় মালেকিন দেবেন।
হাসেমের সঙ্গে ফায়সাল যে রুমে ঢুকল সেটা একটা হল রুম। আট-দশজন লোক টেবিল চেয়ারে বসে কাজ করছে। একপাশে দশফুট বাই বারফুটের কাচের পার্টিশান দেয়া একটা রুম হলেও ভিতরে কি আছে না আছে ফায়সাল দেখতে পেল না। দরজায় দামি পর্দা ঝুলছে।
ফায়সালকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে হাসেম কাচের রুমটা দেখিয়ে বলল, ওখানে মালেকিন আছেন, আসুন। তারপর দরজার কাছে এসে বলল, আপনি ভিতরে যান।
ফায়সাল পর্দা ফাঁক করে বলল, আসতে পারি?
ফায়জুন্নেসা তার দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন।
ফায়সাল ঢুকে সালাম দিল।
ফায়জুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলে কলিং বেল বাজালেন।
হাসেম ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
ফায়জুন্নেসা হাসেমের পরিচয় দিয়ে ফায়সালকে বললেন, এই লোক আপনাকে চৌধুরী স্টেটের যেখানে যা আছে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাবে এবং কিভাবে সবার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে জানাবে। মোট কথা ও যা বলবে, বিনা দ্বিধায় তা আপনাকে করতে হবে। বাই দা বাই, আপনার কি রিভলবার বা পিস্তল আছে?
ফায়সাল বলল, না।
ঠিক আছে, আপনাকে একটা রিভলবার দেয়া হবে, তবে এখন নয়, যখন বুঝব দেয়া দরকার তখন দেব।
আমি এসেছি চাকরি করতে, রিভলবার দিয়ে কি করব? ওসব আমার দরকার নেই।
ফায়জুন্নেসা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, কথার মাঝখানে কথা বলবেন না। আমার কথা শেষ হওয়ার পর যা বলার বলবেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি লাঠিখেলা জানেন?
জি, না।
সাজ্জাদ লেঠেল আপনার সঙ্গে সব সময় থাকবে। তাকে বলে দেব তার কাছে শিখে নেবেন। শুটিং নিশ্চয় জানেন?
জি, জানি।
ফায়জুন্নেসা হাসেমকে বললেন, মৃণালবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়। একটু পরে মৃণাল এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, সালাম মালেকিন।
ফায়জুন্নেসা ফায়সালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মৃণালবাবুকে বললেন, ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে অফিস স্টাফদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে কার কি কাজ জানিয়ে দেবেন। সেই সঙ্গে ম্যানেজার সাহেবকেও ওনার কাজ বুঝিয়ে দেবেন। তারপর ফায়সালকে বললেন, উনি অফিসের বড় বাবু। অফিসের যাবতীয় কাজ ওনার সঙ্গে পরামর্শ করে করবেন। মৃণালবাবু, এবার আপনি আসুন।
মৃণালবাবু চলে যাওয়ার পর ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশ-পাশের গ্রামের কিছু লোক অনেকদিন থেকে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে চলেছে। তারই জের হিসাবে আমাদের ক্ষতি করতে চেষ্টা করে। সে সময় আমরা প্রতিরোধ করি। ফলে উভয় পক্ষের অনেকে হতাহত হয়। আবার কোনো কোনো ম্যানেজারকে ক্যাপচার করে স্বার্থ সিদ্ধি করার চেষ্টাও করে। অবশ্য কোনো ম্যানেজারকেই ক্যাপচার করতে পারে নি। তাই হয় তাকে মেরে ফেলে, নচেৎ এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কেন রিভলবার রাখার ও লাঠি-খেলা শেখার কথা বললাম।