ফায়জুন্নেসা কঠিন কণ্ঠে বললেন, নিজেকে কি ভাবেন আপনি?
মানুষের ঘরে যখন জন্মেছি তখন মানুষই ভাবি।
মানুষ মাত্রই মানুষের ঘরে জন্মায়, জন্তু জানোয়ারের ঘরে জন্মায় না।
কিন্তু মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েও অনেকের স্বভাব-চরিত্র জন্তু-জানোয়ারের মতো হয়। হিংস্র জন্তু-জানোয়ার যেমন শুধু নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝে না, অনেক মানুষ তেমনি নিজের স্বার্থের জন্য ন্যায় অন্যায়ের বাদ বিচার করে না। যাকগে, এসব কথা বলে লাভ নেই। এখন রিকশা পাব বলে মনে হয় না, হেঁটেই স্টেশনে যেতে হবে। কথা শেষ করে ফায়সাল যেতে উদ্যত হলে ফায়জুন্নেসা কঠিন কণ্ঠে বললেন, চৌধুরী বাড়িতে এসে কেউ নিজের ইচ্ছায় চলে যেতে পারে
ফায়সালের তখন আসার সময় স্টেশনে বৃদ্ধের কথা মনে পড়লেও ভয় পেল। বলল, কেউ না পারলেও আমি পারব ইনশাআল্লাহ বলে দু’পা এগিয়ে দেখল, দরজায় তেলচকচকে লাঠি হাতে একজন ভয়ালদর্শন লোক তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। লোকটার গায়ের রং মিশমিশে কালো, ইয়া বড় মোচ, দেখতে যেমন বিশ্রি, তার হাসিটাও তেমনি বিশ্রি। তাকে দেখে একটা ভয়মিশ্রিত শিহরণ ফায়সালের শরীরে খেলে গেল। তার মন তাকে সাবধান করল, তুমি লাঠিখেলা জান না, ঐ লাঠির একটা বাড়ি খেলে মা বলার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তড়িৎ বুদ্ধি খাটিয়ে লোকটাকে বলল, একজন নিরস্ত্র মানুষকে অত্র দিয়ে ঘায়েল করায় কোনো বাহাদুরী নেই।
ফায়সালের কথা শেষ হওয়া মাত্র লোকটা লাঠি ফেলে দিয়ে মোচে তা দিতে লাগল।
ফায়সাল ব্রিফকেসটা মারার ভঙ্গিতে তার দিকে ছুঁড়ে দিতে লোকটা যখন খেলনার মতো লুফে নিতে গেল, ঠিক তখনই ছুটে এসে তার তলপেটের নিচে প্রচণ্ড জোরে একটা পা দিয়ে আঘাত করল।
লোকটা ব্রিফকেস ধরার আগেই ফায়সালের লাথি খেয়ে ব্যথায় নীল হয়ে তলপেট ধরে বসে পড়ল। আর ব্রিফকেসটা তার মাথায় বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ল।
ফায়সালকে তার দিকে এগোতে দেখে ফায়জুন্নেসা খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন, থাক, ওকে আর আঘাত করবেন না। ব্রিফকেসটা নিয়ে এসে বসুন। চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজার হওয়ার উপযুক্ত কিনা জানার জন্য আপনার ইন্টারভিউ নিলাম। আপনি ফুলমার্ক পেয়ে পাশ করেছেন। চাকরির জন্য যে শর্তের কথা বলেছি সেটাও ইন্টারভিউর প্রশ্ন ছিল। তারপর দু’হাতে তালি বাজালেন।
সঙ্গে সঙ্গে দু’জন ষণ্ডামার্কা লোক এসে লাঠিওয়ালা লোকটাকে ধরে নিয়ে গেল।
ফায়জুন্নেসার কথা শুনে ফায়সাল অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তাই দেখে ফায়জুন্নেসা মৃদু হেসে বসতে বলে বললেন, ইন্টারভিউটা বেশ কঠিন হয়েছে, তাই না? কি করব বলুন, মেয়ে হয়ে এতবড় স্টেট চালান কত কঠিন, আশা করি, কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারবেন। তারপর আবার তালি বাজালেন।
এবার আধা বয়সী দু’জন মেয়ে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। ফায়সালকে দেখিয়ে ফায়জুন্নেসা তাদেরকে বললেন, ইনি নতুন ম্যানেজার, তোমরা ওনাকে ওনার রুমে নিয়ে গিয়ে সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা কর। তারপর ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল সকালে আপনার কাজ বুঝিয়ে দেয়া হবে। এখন ওদের সঙ্গে যান।
রুমে এসে ফায়সাল খুশি হল। বেশ বড় রুম, ডবল খাট, খাটের বিছানাপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তিনটে জানালা, একটা দক্ষিণ দিকে, একটা পূর্ব দিকে ও একটা উত্তর দিকে। খাটের পরে প্রায় পাঁচ হাতের মতো ফাঁকা মেঝে। একপাশে একটা টেবিল ও দুটো চেয়ার, বুকসেল্ক ও কাপড় রাখার স্টিলের আলনা। খাট বরাবর পূর্ব দিকের জানালার পাশে ড্রেসিং টেবিল আর উত্তর পাশে বাথরুমের দরজা। বাথরুমসহ পুরোরুম মোজাইক করা। এমন কি দেয়ালও মোজাইক করা। ফায়সালের মনে হল, পুরো বিল্ডিংটাই হয় তো মোজাইক করা।
কাজের মেয়ে দুটো তাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল তখন ফায়সাল তাদেরকে বলে দিয়েছিল, এক ঘণ্টা পরে খাবার নিয়ে আসতে। রুমে। ঢুকে একজন কাজের মেয়ে লাইট ও ফ্যানের সুইচ অন করে দিয়েছিল। ফায়সাল ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে জামা কাপড় পাল্টে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকল। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামায পড়ে ছ’টার বাসে উঠে রংপুরে পৌঁছায়। তারপর ট্রেনে করে নীলফামারী স্টেশনে নেমে রিকশায় এসেছে। এত দীর্ঘ পথ জার্নি করে সে খুব ক্লান্ত। তাই শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে গোসল করল। তারপর সঙ্গে আনা নামাযের মসালা বিছিয়ে এশার নামায পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে যখন মাথা আঁচড়াচ্ছিল তখন দরজার বাইরে থেকে একজন কাজের মেয়ের গলা পেল, “ম্যানেজার সাহেব দরজা খুলুন, খাবার নিয়ে এসেছি।”
ফায়সাল দরজা এমনি ভিড়িয়ে বাথরুমে ঢুকেছিল। বলল, দরজা খোলা আছে, খাবার দিয়ে যান।
দু’জন খাবার নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখল, তারপর একজন চলে গেল আর অন্যজন মেঝের একপাশে মুখ নিচু করে বসে রইল।
ফায়সাল রুমে আসার সময় মানসিক টেনসানে ছিল বলে মেয়ে দুটোকে তেমন লক্ষ্য করে নি। এখন তাদেরকে দেখে মনে হল, এরা ঠিক কাজের মেয়ে নয়, কোনো ন্দ্র ঘরের মহিলা। বয়স প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ, দেখতে শুনতেও ভালো। একজন চলে যাওয়ার পর ফায়সাল সঙ্গে আনা দস্তরখান মেঝেয়। বিছিয়ে টেবিল থেকে খাবারগুলো নামাতে গেলে বসা মেয়েটা তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে বলল, আপনি বসুন, আমি নামিয়ে দিচ্ছি।