হারেস ম্যানেজার হয়ে আসার পর এইসব দেখে শুনে ইনসান চৌধুরীর উপর দিন দিন খুব অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেও সাহসের অভাবে প্রতিবাদ করতে পারে নি। জামাই হওয়ার পর একবার দূরের এক গ্রামের গরিব চাষি ফসলের ভাগ দেয় নি বলে তাকে লোকজন ধরে এনে এমন মার মেরেছিল যে, সেই গ্রামের লোকেরা তাকে পাটার করে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন হারেস বাধা দিয়েছিল বলে লোকটা বেঁচে গিয়েছিল, নচেৎ মারা যেত।
কথাটা ইনসান চৌধুরী জেনে হারেসকে ভবিষ্যতে এরকম না করার জন্য সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, আমার অবর্তমানেও করবে না।
সেদিন হারেস শ্বশুরের সামনে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাষিদের উপরে নির্মম অত্যাচার আর করতে দেবে না।
দিন দিন স্ত্রীর উপরও হারেস অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। সে যেন তাকে ঠিক স্বামীর আসনে গ্রহণ করতে পারে নি। তার কথামতো না চলে, নিজের ইচ্ছা মতো চলে। যখন হারেস স্ত্রীকে সংযত হয়ে চলার জন্য বোঝাত তখন ফায়েজুন্নেসা বলতেন, যারা ঘরজামাই থাকে, তাদের কথা স্ত্রীরা শোনাই না, বরং স্ত্রীদের কথা তাদেরকে মেনে চলতে হয়। এনিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই কলহ হত।
দিনের পর দিন স্ত্রীর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে হারেস একদিন শ্বশুরের কাছে স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করল।
ইনসান চৌধুরী উল্টো জামাইকে দোষারোপ করে বললেন, যে নিজের স্ত্রীকে বশে রাখতে পারে না, সে কাপুরুষ।
শ্বশুরের কথা শুনে হারেস নির্বাক হয়ে ভাবল, চৌধুরী বংশের জামাই হয়ে যে ভুল করেছে, তা জীবনে শুধরাতে পারবে না। চিরকাল তাকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে হবে। তবু হাল ছাড়ল না, স্ত্রী কখন কি করে, কোথায় যায়, একটা বিশ্বস্ত চাকর সামসুকে লক্ষ্য রাখতে বলল।
সামসু অনেক দিন থেকে আছে। ফায়জুন্নেসার সবকিছু জানে। বলল, লক্ষ্য রাখার দরকার নেই। মালিকদের সবকিছু শুধু আমি নই, সব চাকর চাকরানিরাও জানে। কিন্তু আমাদের মুখ খোলা নিষেধ। যদি কেউ খোলে, তা হলে তাকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়। এরকম ঘটনা ঘটতে দেখে আমরা যোবা হয়ে থাকি। আপনাকে আমরা সবাই খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করি, তাই আপনার জন্য আমরা দুঃখ পাই। তবু মুখ খুলতে পারব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, তারপর মালিক কন্যার মন দেয়া নেয়ার কথা বলে বলল, এখনও তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজে লক্ষ্য রাখলে সত্য মিথ্যা জানতে পারবেন।
চাকরের কথা শুনে হারেস সিদ্ধান্ত নিল, সত্য মিথ্যা যাচাই করার দরকার নেই, যেমন করে হোক এখান থেকে পালিয়ে যাবে।
এর কয়েকদিন পর ইনসান চৌধুরীর লাশ জলমহলে পাওয়া গেল।
শশুর মারা যাওয়ার পর হারেসের উপর চৌধুরী স্টেটের ও সংসারের দায় দায়িত্ব পড়ে গেল। পালাবার চিন্তা স্থগিত রেখে সে সব সামলাতে লাগল।
তারপর একদিন মেয়ে যাতে মায়ের মতো না হয় সে জন্যে হারেস হয় বছরের স্বপ্নাকে ঢাকায় এক হোমে রেখে লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করে এল।
ফায়জুন্নেসা মনে মনে খুশি হলেও মুখে বলল, কাজটা তুমি ভালো কর নি।
হারেস বলল, তোমার কাছে ভালো না হলেও আমি স্বপ্নার ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই করেছি।
ফায়জুন্নেসা আর কিছু বলল না।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিভাবে চার-পাঁচ বছর কেটে গেল হারেস বুঝতে পারল না।
বাবা মারা যাওয়ার পর ফায়জুন্নেসা বছর দুই একটু সংযত ছিল। তারপর যত দিন যেতে লাগল তত আগের মতো হয়ে উঠল।
চাকরের কাছে স্ত্রীর দুশ্চরিত্রের কথা জানার পর থেকে হারেস আলাদা রুমে খুমতি এবং তার সংশ্রব থেকে দুরে থাকত। এমন কি তার খোঁজ-খবরও রাখত না। ফলে ফায়জুন্নেসা আরো বেপরওয়া হয়ে উঠে।
চাকর সামসু বয়স্ক লোক। হারেসকে ভীষণ ভক্তি শ্রদ্ধা করে। ওনার মনের কষ্টও বোঝে। তাই মালেকিনকে আগের মতো হয়ে উঠতে দেখে একদিন হারেসকে বলল, আগে রাতের অন্ধকারে মালেকিনের প্রেমিক এলেও ইদানিং বেলা তিনটের দিকে আসে। মালেকিন গেস্টরুমে তার সঙ্গে দেখা করেন।
হারেস জিজ্ঞেস করল, প্রতিদিন আসে?
সামসু বলল, না, যেদিন আপনি অন্য গ্রামে তদারকী করতে যান, সেদিন আসে।
হারেস কথাটা সত্য কিনা যাচাই করার জন্য একদিন অন্য গ্রামে যাওয়ার কথা বলে বেলা দশটার দিকে লোকজন সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রতিবারে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। আজ লোকজনদেরকে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে নিয়ে ফিরে এল। তারপর স্ত্রীর রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল, নেই। নিচ তলায় এসে গেস্ট রুমের দরজা বন্ধ দেখে নক করল।
ফায়জুন্নেসার প্রেমিকের নাম আজিজ। লম্বা চওড়া শরীর, দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। তারা প্রেমকেলীর প্রস্তুতি নেয়ার আগে দরজায় নক হতে শুনে আজিজ ফায়জুন্নেসার দিকে তাকাল।
ফায়জুন্নেসা দরজায় নক হতে শুনে রেগে লাল হয়ে গেল। কারণ সে জানে কারো ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে, এসময়ে এই রুমের দরজা নক করবে। বারবার নক হতে শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দরজা খুলে স্বামীকে দেখে চমকে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?
হারেস তার কথার উত্তর না দিয়ে আজিজের আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে? এ সময়ে এখানে কেন?
আজিজ কিছু বলার আগে ফায়জুন্নেসা বলল, ও পাশের গ্রামের ছেলে। আমরা একসঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছি। ওকে আমিই ডেকে পাঠিয়েছি।