গ্রামবাসির মধ্যে বসির অল্প শিক্ষিত হলেও খুব বুদ্ধিমান। সে বলল, আই. জি. সাহেবের চাকরি ছেড়ে দিন। আমরা সবাই সামর্থ অনুযায়ী কিছু কিছু জমি আপনাকে দেব, থাকার জন্য ঘর করে দেব, তবু আপনাকে যেতে দেব না।
ফায়সাল বলল, ঠিক আছে, আই. জি. সাহেব চিঠির উত্তরে কি জানান আগে দেখি, তারপর কি করব না করর জানাব।এবার আপনাদেরকে চলে যাওয়ার অনুরোধ করছি।
ফায়সালের কথা শুনে আশস্ত হয়ে লোকজন চলে গেল।
ফায়সাল চলে যাবে তাই অফিসে এসে মৃণালবাবু ও স্বপ্নাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ডেকে পাঠাল।
মৃণালবাবু এসে বললেন, ছোট মালেকিন তো আজ উপর থেকে নামেন নি।
ফায়সাল হাশেম মিয়াকে বললেন, ছোট মালেকিনকে আসতে বলুন।
হাশেম ফিরে এসে বলল, ওনার শরীর খারাপ, আসতে পারবেন না।
ফায়সাল মৃণালবাবুকে বললেন, আপনাকেসহ ছোট মালেকিনকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে চাই, কিন্তু উনি আসতে পারছেন না। কাল সবকিছু বুঝিয়ে দেব।
পরপর তিন দিন একই কারণে স্বপ্না অফিসে এল না দেখে ফায়সাল চিন্তিত হল। ভাবল, কি হয়েছে জানা উচিত। তাই চাকরানি আকলিমা রাতের খাবার নিয়ে এলে জিজ্ঞেস করল, ছোট মালেকিনের কি হয়েছে?
আকলিমা বলল, কি হয়েছে জানি না, তবে আজ তিন দিন পানি ছাড়া কিছুই খান নি, রুম থেকে বারও হন নি, সব সময় মন ভার করে শুয়ে থাকেন।
ডাক্তার দেখান হয়েছে?
তা বলতে পারব না।
১৯৭
ফায়সালের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। আর কিছু না বলে খেতে শুরু করল।
খাওয়া শেষ হতে আকলিমা বাসন পেয়ালা নিয়ে যেতে উদ্যত হতে বলল, নানি আম্মাকে বলবেন, আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
একটু পরে আকলিমা ফিরে এসে বলল, আসুন। দোতলায় এসে আকলিমা তাকে ড্রইংরুমে বসতে বলে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর লুৎফা বেগমকে ঢুকতে দেখে ফায়সাল দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
লুৎফা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, বয়স হয়েছে ভাই, শরীরে নানা রকম উদ্রব শুরু হয়েছে। তা কবে যাবে জানাতে এসেছ বুঝি? গ্রামের লোকজন সে কথা জানে?
কবে যাব এখনও ঠিক করি নি। আপনার নাতনির কি হয়েছে জানতে এসেছি। কি হয়েছে ওনার?
লুৎফা বেগম নাতনি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে জেনে তার সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছেন, ম্যানেজার তাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি বলে তার এই অবস্থা। ফায়সালের কথা শুনে বললেন, কি হয়েছে আমরা জিজ্ঞেস করেও জানতে পারি নি। তুমি পার কি না দেখ। তারপর তাকে নিয়ে নাতনির রুমের দরজার কাছে এসে বললেন, একটু দাঁড়াও ঘুমিয়েছে না কি দেখি। তারপর পর্দা ঠেলে ঢুকে তাকে চোখের পানি ফেলে মোনাজাত করতে দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
স্বপ্নার দৃঢ় ধারণা, ম্যানেজার তাকে ভীষণ ভালবাসলেও পূর্বপুরুষ জয়নুদ্দিনের কারণে বিয়ে করবেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চিরকুমারী থাকবে আর ম্যানেজার চলে যাওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা করবে না। এই ক’দিন শুধু কেঁদেছে আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেহে, “আল্লাহ তুমি সর্বজ্ঞ। আমার অন্তরের কথা তুমি জান। আমি ওকে ছাড়া বাঁচব কি না তাও জান। ওর দ্বারা তুমি আমাকে হেদায়েত দিয়েছ। তোমার উপর ভরসা করে সবর করে আছি। তুমিই এর ফায়সালা করে দাও, দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে আমার মনের বাসনা পূরণ করে দাও। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর শত কোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। ওনার অসিলায় তোমার এই নগন্য গোনাহগার বান্দির দোয়া কবুল কর আমিন।”
আজ এশার নামায পড়ে দোয়া শেষ করে যায়নামায গুটিয়ে রেখেছে, এমন সময় লুৎফা বেগম ম্যানেজারের আসার কথা বলে নাতনিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে স্থাপদে বেরিয়ে এসে ফায়সালকে বললেন, ও জেগে আছে তুমি যাও, আমি ড্রইংরুমে আছি। কথা শেষ করে দ্রুত চলে গেলেন।
নানির কথা শুনে স্বপ্না চমকে উঠল। সে ভাবতেই পারে নি ম্যানেজার তাকে দেখতে আসবেন। ভাবল, তা হলে কি আল্লাহ এই নাদান বান্দির দোয়া কবুল করেছেন? নানিকে কিছু বলতে যাচ্ছিল; ওনাকে চলে যেতে দেখে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
ফায়সাল ঢুকে সালাম দিতে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
এক সময় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
ফায়সাল তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এগিয়ে এসে বলল, সালামের উত্তর দিলেন না যে? গুনাহ হবে তো?
স্বপ্না সালামের উত্তর দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, কেন এসেছেন?
ফায়সাল বলল, স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটি আজ তিন দিন আমার সঙ্গে অভিসারে বের হয় নি, তাই আমিই এসেছি তার সঙ্গে অভিসার করতে।
কান্নাজড়িত স্বরে স্বপ্না বলল, আপনি এত নিষ্ঠুর? এরকম কৌতুক করে আমার জ্বলন্ত হৃদয়ে ঘি ঢালতে পারলেন?
আমি নিষ্ঠুরও নই আর কৌতুকও করি নি। যা সত্য, তাই বলেছি।
তা হলে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন কেন?
প্রত্যাখান তো করি নি, এড়িয়ে গেছি।
এড়িয়ে যাওয়া মানেই প্রত্যাখান করা।
না, আপনি ঠিক বলেন নি, দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে।
পার্থক্য থাক বা না থাক, এড়িয়ে গেলেন কেন বলুন।
আমি যেমন আপনাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসেছি এবং আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের জোড়া কবুল করেন। তেমন আপনিও আমাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালবেসেছেন এবং আল্লাহর কাছে ঐ একই দোয়া করেন। তবু কেন আমার প্রতি আপনার সন্দেহ হল বুঝতে পারছি না। আপনার মা ও নানির কাছে যা বলেছি, তা যেমন সত্য, এখন যা আপনাকে বললাম, তা তেমনি সত্য। আপনার কথা মা বাবাকে অনেক আগেই জানিয়েছি। আরও জানিয়েছি, খোকসাবাড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর ওনাদেরকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠাব। ওনারা এসে যেন আপনাকে পুত্রবধূ করার ব্যবস্থা করেন। গত পরশু মা বাবাকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠিয়েছি। আল্লাহ রাজি থাকলে কাল এসে যাবেন।