লুৎফা বেগম বুঝতে পারলেন, ম্যানেজার স্বপ্নাকে বিয়ে করতে রাজি নয়, মেয়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে চুপ করে রইলেন।
ফায়জুন্নেসা ফায়সালের কথা শুনে মনঃক্ষুন্ন হলেন। মাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি এত জ্ঞানী গুণী হয়ে মিথ্যে কথা বলবেন ভাবতেই পারছি না। আমরা জানি আপনার মা বাবা নেই, শুধু একজন ফুপু আছেন।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, আল্লাহর কোনো মুমেন বান্দা মিথ্যা বলতে পারে না। যারা গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে, তাদের আসল পরিচয় বাইরের লোকের কাছে গোপন রাখতে হয়। তাই চাকরির সময় যে বায়োডাটা দিয়েছি, সেটা আসল নয়।
লুৎফা বেগম মেয়েকে ধমকের স্বরে বললেন, আমি যখন কথা বলছি তখন তোমার চুপ করে থাকা উচিত। তারপর ফায়সালকে বললেন, যাওয়ার আগে ঠিকানা দিয়ে যেও, আমরা তোমার মা বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
মাফ করবেন, ঠিকানা দেয়া সম্ভব নয়। কারণটা তো একটু আগে বললাম। এবার লুৎফা বেগমও মনঃক্ষুন্ন হলেন। তা প্রকাশ না করে বললেন, কবে এখান থেকে যাবে?
এখনও সিদ্ধান্ত নিই নি, তবে দু’চার দিনের মধ্যে যেতেই হবে।
ঠিক আছে, এবার এস।
.
কুলসুম যখন খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে তখন স্বপ্না দরজা লাগিয়ে চিন্তা করছিল, আজ মা নিশ্চয় নানিকে দিয়ে প্রস্তাব দেওয়াবে। তাই আধা ঘন্টা পর বেরিয়ে এসে ড্রইংরুমের জানালার পর্দা অল্প একটু ফাঁক করে এতক্ষণ তাদের আলাপ শুনছিল। নানি এবার এস বলতে নিজের রুমে ফিরে এসে চিন্তা করতে লাগল, ম্যানেজারের স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটা যদি আমি হই, তা হলে নানির প্রস্তাবে রাজি না হয়ে এড়িয়ে গেলেন কেন? মনে হয়, ওনাকে ধূর্ত, শঠ ও ঠক ধার্মিক ভাবতাম জেনে গ্নের মেয়েটির মিথ্যে কাহিনী বানিয়ে শুনিয়েছেন। কিন্তু ওনার মতো ছেলে তো মিথ্যা কাহিনী বানিয়ে বলতে পারেন না। তা ছাড়া ওনার চোখের দৃষ্টিতে যা দেখেছি, তাও মিথ্যা হতে পারে না। তখন তার মাস ছয়েক আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল। একদিন ম্যানেজার তাকে দূরের এক জলমহল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে স্বপ্না বলল, আপনি তো বলেছিলেন, স্বপ্নের সেই মেয়েটি কিছুদিনের মধ্যে আপনার সঙ্গে বাস্তবে অভিসার করবে, কই, আজ দেড় বছর হয়ে গেল একবারও অভিসার করল না?
ফায়সাল মৃদু হেসে বলেছিল, আপনি বুঝতে পারেন নি, সে তো প্রায় প্রতিদিন অভিসারে আসে এবং আজও আমার সঙ্গে অভিসারে বেরিয়েছে।
স্বপ্নাও মৃদু হেসে বলল, যদি তাই হয়, তা হলে তার সঙ্গে শুধু কাজের কথা আলাপ করেন কেন? অভিসারে বেরিয়ে তো প্রেমালাপ ও করে?
তা অবশ্য করে, কিন্তু মেয়েটিও করে না কেন বলতে পারেন?
স্বপ্নে লজ্জা পেত না, বাস্তবে পায় বলে। এবার একটা কথা বলব, রাখতে হবে।
বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
আমরা তুমিতে আসতে পারি না?
দুঃখিত তা সম্ভব নয়।
কেন?
কর্মচারী হয়ে মালিককে তুমি বলা কি উচিত?
মালিক তো বলার অনুমতি দিচ্ছে? তা ছাড়া মালিক তো এখন প্রেমিকা?
তবুও সম্ভব নয়। কারণ এটা খুব অশোভনীয়। তা ছাড়া আমি ছোট বড়, এমন কি চাকর-চাকরানিদেরও, আপনি করে বলি।
কারণটা বলবেন?
সবাইকে আমার থেকে বড় ও জ্ঞানী মনে করি।
আর যারা গরিব ও মূর্খ?
তাদেরকেও। কারণ একজন মানুষ শিক্ষিত বা ধনী হলেও গরিব বা মূর্খরা এমন অনেক জিনিস জানেন, যা অনেকেই জানেন না।
বিয়ের পরেও কি আমাকে আপনি করে বলবেন?
নিশ্চয় বলব।
কেউ নিজের স্ত্রীকে আপনি করে বলে?
কেউ না বললেও আমি বলব।
আমার লজ্জা করবে না বুঝি?
প্রথম প্রথম করবে, পরে করবে না।
তা হলে আমিও কি আপনি করে বলব।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু আপনি করে বললে দূরত্ব থেকে যায়।
ওটা মনের ভুল। আমার ধারণায় আপনি করে বললে ভক্তি, শ্রদ্ধা যেমন আরো বাড়ে, তেমনি প্রেমিক প্রেমিকার মর্যাদা স্থায়ী হয়। তুমি বা তুই করে বললে, একে অপরকে অপমান করা হয়, একজন অন্য অন্যের কাছে হেয়, মানে ছোট হয়ে যায়।
এরপরও ম্যানেজার নানির প্রস্তাব এড়িয়ে গেলেন কেন চিন্তা করতে করতে এক সময় স্বপ্না ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালে কয়েকশ গ্রামবাসি চৌধুরী বাড়ির গেটে এসে শ্লোগান দিতে লাগল, “আমরা ম্যানেজারকে এখান থেকে যেতে দেব না।”
হট্টগোল শুনে স্বপ্না, ফায়জুন্নেসা ও লুৎফা বেগম বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। দারোয়ানকে আসতে দেখে ফায়জুন্নেসা জিজ্ঞেস করলেন, এত লোকজন এসেছে কেন? তারা কি চায়?
দারোয়ান বলল, ওরা ম্যানেজার সাহেবকে এখান থেকে যেতে দিতে চাচ্ছে।
ফায়জুন্নেসা বললেন, ম্যানেজারকে কথাটা জানাও।
দারোয়ানের মুখে ঘটনা শুনে ফায়সাল গেটের বাইরে এলে লোজন বার বার ঐ একই শ্লোগান দিতে লাগল।
ফায়সাল তাদের চুপ করতে বলার পর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিরবতা নেমে এল।
ফায়সাল বলল, আমি কেন চলে যাচ্ছি, তা আপনারা গতকাল আই জি. সাহেবের কাছে শুনেছেন। তারপরও এরকম কেন করছেন বুঝতে পারছি না।
লোকজন চিৎকার করে বলল, কারও কথায় আপনাকে কিছুতেই যেতে দেব না। প্রয়োজনে এখানে আমরা আমরণ অনশন করে পড়ে থাকব।
ফায়সাল তাদেরকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো কাজ হল না। শেষে বলতে বাধ্য হল, আমি আই. জি সাহেবকে আপনাদের কথা চিঠি দিয়ে জানাব। উত্তর না আসা পর্যন্ত যাব না। এবার আপনারা দয়া করে ফিরে যান।