.
ফায়সালের আসল পরিচয় জেনে ও তার বক্তব্য শুনে ফায়জুন্নেসা প্রথম দিকে যেমন খুশি হয়েছিলেন তেমনি অবাকও হয়েছিলেন। কিন্তু ফায়সাল যখন আজিজের সঙ্গে তার মন দেয়া-নেয়ার কথা বলে তখন একথা ভেবে ভয় পেয়েছিলেন যে, স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায় ও মারা যাওয়ার পর আজিজের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের কথা যদি প্রকাশ করে দেন, তা হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। কথাটা ভেবে ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ফায়সাল কৌশলে ঐ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবলেন, ফায়সাল মানুষ হলেও তার চরিত্র ফেরেশতার মতো।
লুৎফা বেগমও খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, যদি ফায়সাল ওদের অবৈধ সম্পর্কের কথা প্রকাশ করে দেয়, তা হলে চৌধুরী বংশের ইজ্জৎ ধুলোয় মিশে যাবে। ফায়সাল তা করল না দেখে তিনিও তার প্রতি খুব সন্তুষ্ট হবেন।
আর স্বপ্না ফায়সালের পরিচয় পেয়ে যতটুকু খুশি হয়েছিল, পূর্ব পুরুষ জয়নুদ্দিনের ধনী হওয়ার ঘটনা শুনে তার থেকে অনেক বেশি নিজের কাছে নিজেকে ঘৃণিত মনে করতে লাগল। ভাবল, চৌধুরীদের এত বিশাল সম্পত্তির পিছনে রয়েছে ডাকাতদের ডাকাতির অবৈধ সম্পদ।
বাড়িতে এসে মেয়ের মন খারাপ দেখে ফায়জুন্নেসা জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, শরীর খারাপ?
স্বপ্না বলল, না।
তা হলে তোর মন খারাপ কেন?
পূর্ব পুরুষ জয়নুদ্দিনের ধনী হওয়ার ঘটনা শুনে।
এতে মন খারাপের কি হল? আমরা তো অন্যায় কিছু করি নি?
না করলেও আমরা ওনার সেই অন্যায়ভাবে হস্তগত সবকিছু তো ভোগ করছি?
হ্যাঁ, তা করছি। তবে এজন্য তো আমরা দায়ী নই। ওসব কথা মন থেকে মুছে ফেলে এখন কি করবি চিন্তা কর।
স্বপ্না অবাক হয়ে বলল, কি চিন্তা করব?
এরই মধ্যে ভুলে গেলি? ম্যানেজারকে জামাই করার ব্যাপারে সেদিন আমাদের সিদ্ধান্তের কথা তোকে বললাম না?
উনি সরকারি লোক, সরকারি কাজে এসেছিলেন। কাজ শেষ হয়েছে, ওনার বস এবার ঢাকায় ফিরে যেতে বললেন, শুনলে না।
তা তো শুনেছি। এর সঙ্গে বিয়ের কোনো সম্পর্ক থাকবে কেন?
সম্পর্ক নেই ঠিক; কিন্তু আমাকে বিয়ে করবেন কি না তাতে তোমরা জান? প্রস্তাব দিলে যদি রাজি না হন?
কেন হবেন না? তুই তো বলেছিলি, “তিনি তোকে ভীষণ ভালবাসেন, তোকে না পেলে সারাজীবন বিয়েই করবেন না।”
আমাকে নয়, উনি ওনার স্বপ্নে দেখা মেয়েটির কথা বলেছিলেন।
ওনার স্বপ্নে দেখা মেয়েটি যে তুই, সে কথাও তো বলেছিলি। আমি তোর নানিকে দিয়ে প্রস্তাব দেওয়াব।
দু’বছর তার সঙ্গে মেলামেশা করে স্বপ্না ফায়সালকে এত ভালবেসে ফেলেছে যে, তার কেবলই মনে হয় তাকে ছাড়া বাঁচবে না। তাই সে এবার চলে যাবে, জানার পর থেকে তার মন ভীষণ ছটফট করছে। প্রস্তাব দেয়ার কথা শুনে ভাবল, পূর্বপুরুষ জয়নুদ্দিনের কারণে হয়তো ফায়সাল তাকে ভীষণ ভালবাসলেও স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবে না। কথাটা ভেবে তার চোখে পানি এসে যেতে মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।
কি রে, কিছু বলছিস না কেন?
ভিজে গলায় জানি না যাও বলে স্বপ্না সেখান থেকে নিজের রুমে এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
রাতে খাওয়ার টেবিলে লুৎফা বেগম মেয়েকে বললেন, স্বপ্না কোথায়? ওকে ডাক।
ফায়জুন্নেসা কুলসুমকে বললেন, স্বপ্না আসে নি কেন দেখে এস।
কুলসুম ফিরে এসে বলল, আপা দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছেন, ডাকতে বললেন, খাবেন না।
লুৎফা বেগম মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর শরীর খারাপ নাকি?
ফায়জুন্নেসা মেয়ের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। বললেন, না, তবে মন খুব খারাপ দেখলাম।
হঠাৎ মন খারাপ কেন হল?
মনে হয়, ম্যানেজার ঢাকা চলে যাবেন শুনে মন খারাপ, তারপর তার সঙ্গে যা আলাপ করেছেন বললেন।
লুৎফা বেগম কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে রুমে যাওয়ার সময় বললেন, ম্যানেজারকে ডেকে পাঠাও তার সঙ্গে কথা বলব।
ফায়সাল দোতলায় ড্রইংরুমে এসে সালাম দিয়ে ঢুকে দেখল, লুৎফা বেগম ও ফায়জুন্নেসা বসে আছেন, স্বপ্না নেই।
ফায়জুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন।
ফায়সাল বসার পর লুৎফা বেগম বললেন, সরকারি কাজে এসেছিলে, কাজ শেষ হয়েছে, এবার তা হলে চলে যাচ্ছ?
ফায়সাল বলল, সরকারের চাকরি করি, সরকারের হুকুম তো মানতেই হবে।
আমরাও তো তোমাকে চাকরি দিয়ে আনিয়েছি। সে ব্যাপারে কি করবে?
সরকারের আদেশ অনুসারে এখানে রিজাইন দিতে হবে।
হতে আমরা যদি এ্যাকসেপ্ট না করি।
এ্যাকসেপ্ট না করার কোনো কারণ তো দেখছি না। বরং জিনের ও মানুষের দুশমণী থেকে আপনাদের দুশ্চিন্তা আল্লাহর ইচ্ছায় দূর করে দিয়েছি, সে জন্য খুশি মনে এ্যাকসেপ্ট করাই তো উচিত। তা ছাড়া আপনারা শিক্ষিত, সরকারের আদেশ আমার মানা উচিত, তা তো ভালো করেই জানেন।
আমরা শিক্ষিত হলেও তোমার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি আমাদের নেই। তাই তর্কে তোমার সঙ্গে পারব না। তাই এ ব্যাপারে আর কথা বলব না, তুমি যা ভালো বুঝবে করবে। এবার একটা কথা বলব, আশা করি, রাখবে।
বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।
আমরা তোমার হাতে স্বপ্নাকে দিতে চায়।
কে দিতে চায়।
ফায়সাল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল, লুৎফা বেগম এ কথা বলবেন। তাই কি বলবে ভেবে রেখেছিল। বলল, বিয়ের ব্যাপারে আমার নিজস্ব কোনো মতামত নেই। মা-বাবা যদি একটা কুৎসিত অন্ধ, কানা, খোঁড়া বা বোবা মেয়েকে বৌ করতে চান, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।