ঐ ডাকাত দলে সামশের নামে একজন ছিলেন। তিনি হলেন পাশের গ্রামের আজিজ মিয়ার পরদাদা অর্থাৎ দাদার বাবা। জেলে সামশেরের আচরণ ভালো হওয়ায় মেয়াদ শেষ হওয়ার দু’বছর আগে ছাড়া পান। তারপর সেই দীঘিতে যেখানে টাকা ও গহনার কলস ফেলেছিল, সেখানে কয়েকদিন গভীর রাত্রে জাল ফেলে নিরাশ হয়ে ডোমার গ্রামে খোঁজ করতে লাগলেন, হঠাৎ কেউ বড়লোক হয়েছে কিনা। একদিন একজন লোকের কাছে জানতে পারলেন, বছর চারেক আগে হত-দরিদ্র জয়নুদ্দিন স্ত্রী ও একছেলেকে নিয়ে খোকসাবাড়িতে গিয়ে খুব বড়লোক হয়ে চৌধুরী উপাধি নিয়ে বাস করছেন। কথাটা জেনে সামশেরের দৃঢ় ধারণা হল, এই জয়নুদ্দিনই নিশ্চয় টাকা ও গহনার কলস পেয়েছে। বাড়িতে ফিরে এসে একদিন জয়নুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন ওনার হঠাৎ গ্রাম ছেড়ে এখানে আসার ও হত-দরিদ্র হয়ে কি করে এত বড় লোক হলেন।
জয়নুদ্দিন তখন গ্রামের প্রভাবশালী লোক। সামশেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন।
সামশের লোক পরম্পরায় জানতে পারলেন, জয়নুদ্দিন জিনেদের একঘড়া সোনার মহর পেয়ে এখানে এসে বসবাস করছেন। তখন ওনার ধারণাটা আরও দৃঢ় হল। জয়নুদ্দিন আসল কথা চেপে গিয়ে জিনেদের সোনার মহরের ঘড়ার কথা বলেছেন। তারপর শুরু করলেন শতা। সময় সুযোগ মতো জয়নুদ্দিনের গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে জলমহলে ফেলে দেন। এর কিছুদিন পর সামশের মারা যান। মারা যাওয়ার আগে ছেলে সারওয়ারকে জয়নুদ্দিনের কাহিনী বলে যান। সারওয়ার সময় সুযোগ মতো জয়নুদ্দিনের ছেলে আবসার উদ্দিনকে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে একই জলমহলে ফেলে দেন। সারওয়ার মারা যাওয়ার আগে ছেলে সোরাব উদ্দিনকে সবকিছু বলে ইনসান চৌধুরীকে একইভাবে হত্যা করার কথা বলে যান। কিন্তু তা করার আগে হঠাৎ সোরাব উদ্দিন মারা যান। তখন ওনার ছেলে আজিজ ক্লাস টেনে পড়ে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ইনসান চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে ফায়জুন্নেসার সঙ্গে মন দেয়া-নেয়া হয়। কলেজে পড়ার সময় আজিজ দাদিকে কথাটা জানিয়ে বলেন, বি.এ. পাশ করে আমি ফায়জুন্নেসাকে বিয়ে করব।
নাতির কথা শুনে দাদি আয়শা খাতুন চিন্তা করলেন, সোরাব উদ্দিন যে কাজ করতে পারে নি, আজিজকে দিয়ে তা করাতে হবে। বললেন, তোর কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। তারপর চৌধুরীদের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের শত্রুতার কারণগুলো বলে বললেন, ইনসান চৌধুরী হল বিশাল হাঙ্গর মাছের মতো আর আমরা হলাম চুনো পুঁটি মাছের মতো। উনি মেয়েকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবেন তবু তোর সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। তাই বি.এ. পাশ করার পর তোর প্রথম কাজ হবে ইনসান চৌধুরীকে তার বাপ-দাদার মতো হত্যা করে জলমহলে ফেলে দেয়া। তারপর ঐ মেয়েকে বিয়ে করে তুই চৌধুরী স্টেটের মালিক হবি। দাদির কথা মতো আজিজ বি.এ. পাশ করার পর ইনসান চৌধুরীকে হত্যা করার সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। এদিকে ইনসান চৌধুরী তার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কের কথা জেনে স্টেটের ম্যানেজার হারেসের সঙ্গে ফায়জুন্নেসার বিয়ে দেন। আজিজ সে কথা জেনে শশুর জামাই দুজনকেই হত্যা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারপর সুযোগ পেয়ে প্রথমে ইনসান চৌধুরীকে পূর্বপুরুষদের মতো একই কায়দায় হত্যা করে জলমহলে লাশ ফেলে দিলেন। এটাকেও সবাই জিনেদের দুশমনী ভাবলেন। এমন কি থানার পুলিশরাও তাই ভেবেছিলেন। তারপর কৌশলে ইনসান চৌধুরীর জামাইকেও একই পন্থায় হত্যা করে এবং কৌশলে ফায়জুন্নেসার মন জয় করে স্টেটের ম্যানেজার হন। ম্যানেজার হওয়ার পর স্টেটের আয় থেকে টাকা মেরে অনেক জমি-জায়গা করে ধনী হয়ে যান। তারপর ফায়জুন্নেসাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ততদিনে আজিজের ধনী হওয়ার কথা ফায়জুন্নেসা শুনেছেন এবং স্টেটের আয় ব্যয়ের হিসাবে অনেক কারচুপি জানতে পারেন। তাই বিয়ের প্রস্তাব শুনে ফায়জুন্নেসা আজিজের মতলব বুঝতে পারেন এবং ওনাকে যা তা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। তারপর থেকে আজিজ তার গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে চৌধুরী স্টেটের ক্ষতি করেই চললেন।
ওসি ফায়সালকে জিজ্ঞেস করলেন, এতকিছু জেনেও আজিজকে আগেই এ্যারেস্ট করার ব্যবস্থা করলেন না কেন?
ফায়সাল বলল, আজিজ ও ওনার পূর্ব পুরুষরা যে একের পর এক চৌধুরী স্টেটের মালিকদের হত্যা করেছেন, তা আগে জানতে পারি নি।
তারপর চৌধুরীদের টাকা আত্মসাৎ করে যে সব সম্পত্তি করেছিলেন, সেগুলো মাদরাসায় কিভাবে ওয়াকফ করলেন সে সব বলে বললেন, মৃত্যু শয্যায় উনি আমাকে এসব কথা বলেছেন।’
এবার আই.জি. সাহেব ফায়সালকে বললেন, এই জটিল রহস্য উঘাটন করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, অতি শিঘ্রি ঢাকা অফিসে জয়েন করবেন।
ফায়সাল বলল, জি, করব।
ধর্ম মন্ত্রী ফায়সালের ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন, আমি জেনেছি, আপনি সরকারি কাজে এসে এই দু’বছরের মধ্যে খোকসাবাড়ি থানার সমস্ত গ্রামের মানুষকে উন্নতির পথ দেখিয়েছেন, চৌধুরীদের শত্রুকে মিত্র করেছেন এবং জিনেদের দুশমনী করার যে ধারণা করে চৌধুরীরা এতকাল আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ছিলেন, তা দূর করে কিংবদন্তীর অবসান ঘটালেন। সে জন্য সরকার থেকে। আপনাকে পুরস্কৃত করা হবে। তারপর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।