এই ঘটনার প্রায় বার বছর পর ওনার একমাত্র সন্তান আবসার উদ্দিনের লাশও ঐ একই জলমহলে পাওয়া যায়। বাবা ও ছেলে একইভাবে মারা যাওয়ার ঘটনায় লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ঐ বংশের উপর জিনেদের আক্রোশ আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে।
আবসার উদ্দিন চৌধুরীর একমাত্র সন্তান ইনসান চৌধুরীর বয়স যখন ত্রিশ বছর তখন একদিন ওনার লাশও ঐ একই জলমহলে পাওয়া যায়। ময়নাতদতে ওই একই রিপোর্ট, গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। তখন থেকে শুধু গ্রামের লোকজনই নয়। চৌধুরী বাড়ির সকলেরও ঐ ধারণা দৃঢ় হয়।
ইনসান চৌধুরীর স্ত্রী লুৎফা বেগম ঢাকার ধনী পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে। তিনি ভূত-পেত্নি বা জিন বিশ্বাস করেন না। এই বংশের উপর জিনদের আক্রোশ আছে, স্বামী, শ্বশুর ও দাদা শ্বশুরকে জিনেরা মেরে ফেলেছে তাও বিশ্বাস করেন না। ওনার বিশ্বাস, দাদা শ্বশুর অন্য জায়গা থেকে এসে এখানে এত সম্পত্তি করেছেন, চৌধুরী বংশের এত নাম ডাক, এখানকার অনেকে সহ্য করতে না পেরে একের পর এক এই ঘটনা ঘটিয়ে জিনেদের আক্রোশ বলে রটিয়েছে।
ইনসান চৌধুরী মারা যাওয়ার সময় ওনার মা হাফেজা বেগম বেঁচে ছিলেন। তিনি শাশুড়ির কাছে সোনার মোহর পাওয়ার কথা শুনেছিলেন। তাই স্বামী, শ্বশুর ও ছেলেকে যে জিনেরা মেরে ফেলেছে, সে কথা বিশ্বাস করেন। বৌ লুৎফা বেগম ওসব বিশ্বাস করে না জেনে একদিন তাকে বললেন, ভূত-পেত্নী আছে কি না জানি না। তবে জিন জাতি আছে একথা বিশ্বাস করি। কারণ কুরআনে জিন জাতির কথা উল্লেখ আছে। এমন কি জিন নামে একটা সূরাও আছে। তা ছাড়া জিনেদের সম্পর্কে আমাদের নবী (দঃ)-এর হাদিসে বর্ণনাও আছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানকে জিন পৃথিবীতে আছে বিশ্বাস করতেই হবে। তারপর ওনার শশুরের সোনার মোহর পাওয়ার কথা ও নিজের গ্রাম ছেড়ে কেন এখানে চলে • আসেন বললেন।
শাশুড়ির কথা শুনে লুৎফা বেগম কিছুটা বিশ্বাস করতে পারলেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাই জিজ্ঞেস করলেন, জিনেদের আক্রোশ থেকে রেহাই পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই?
হাফিজা বেগম বললেন, এই কথা আমিও আমার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, কোনো পীর সাহেব বা বড় আলেমের কাছে ঘটনাটা বলে তদবির করলে হয়তো জিনেদের আক্রোশ থেকে রেহাই পাওয়া যেত। তিনি স্বামীকে কথাটা বলেও ছিলেন; কিন্তু সোনার মোহর পাওয়ার ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবে বলে তদবির করতে রাজি হন নি। কথাটা ইনসানকেও বলেছিলাম, সেও একই কথা বলে তদবির করতে রাজি হয় নি।
লুৎফা বেগম বললেন, এই বংশের পুরুষের উপর জিনেদের আক্রোশ। এখনতো আর কোনো পুরুষ নেই, মনে হয় তারা এই বংশের মেয়েদের উপর কিছু করবে না।
হাফিজা খাতুন বললেন, কি করে সে কথা বলব? আমার তো খুব ভয় হয়, চৌধুরী বংশের একমাত্র প্রদীপ ফায়জুন্নেসাকে নিয়ে। ওর কিছু হলে চৌধুরী সংশের নাম নিশানা দুনিয়া থেকে মুছে যাবে। তাই বলি কি, তুমি তোমার বাবাকে সবকিছু জানিয়ে কোনো পীর সাহেব বা কোনো আলেমের দ্বারা তদবির করাও।
স্বামী ও তার উর্ধ্বতন পুরুষরা যে কারণে জিনেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তদবির করেন নি, লুৎফা বেগমও সেই একই কারণে কিছু করেন
ইনসান চৌধুরী মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে হারেস নামে একটা ছেলের সঙ্গে একমাত্র মেয়ে ফায়জুন্নেসার বিয়ে দেন। হারেস ঢাকার শিক্ষিত ও সুদর্শন ছেলে। সে প্রথমে চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজার ছিল। ইনসান চৌধুরী মেয়ের বিয়ের জন্য এমন পাত্রের খোঁজ করছিলেন, যে নাকি সব দিক থেকে চৌধুরী বংশের উপযুক্ত এবং ঘরজামাই থেকে চৌধুরী স্টেটের ভার নিতে পারবে। ম্যানেজার হারেসকে ওনার পছন্দ হলেও বংশের মর্যাদার কথা ভেবে আল কে সায় পান নি। তারপর যখন জানতে পারলেন, পাশের গ্রামের এক সাধারণ ছেলের সঙ্গে মেয়ের মন দেয়া নেয়া হয়েছে তখন স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ হারেসের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে তাদের একটা মেয়ে হয়। ইনসান চৌধুরী নাতনির নাম রাখেন জেবুন্নেসা। ডাক নাম স্বপ্না।
বিয়ের সময় ফায়জুন্নেসার কোনো প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না। তবু মায়ের কাছে মন দেয়া নেয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু কাজ হয় নি। কথাটা শুনে লুৎফা বেগম মেয়ের সাথে রাগারাগি করেন। ফলে এক রকম বাধ্য হয়ে সে হারেসকে বিয়ে করে।
হারেস ইনসান চৌধুরীর মেয়ের মন দেয়া-নেয়ার কথা না জানলেও তার উগ্র মেজাজের কথা জানত। তাই ইনসান চৌধুরী যখন তাকে জামাই করার কথা জানালেন তখন বলল, আমি আপনার মেয়ের অনুপযুক্ত। তা ছাড়া ঘরজামাই হয়ে থাকা আমার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়।
ইনসান চৌধুরী ভাবতেই পারেন নি, হারেস অমত করবে। রাগে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। একসময় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এর পরিণাম চিন্তা করছ?
জি করেছি, আমার চাকরি থাকবে না।
একই কষ্ঠে ইনসান চৌধুরী বললেন, শুধু চাকরি নয়, প্রাণ নিয়ে এখান থেকে ফিরে যেতে পারবে না। তারপর নরম সুরে বললেন, তোমার মতো ছেলেই চৌধুরী বংশের জামাই হওয়ার উপযুক্ত। আমার পরে তুমিই হবে এই বংশের কর্ণধার। তারপর অনেক কিছু প্রলোভন দেখিয়ে হারেসকে রাজি করান।
ইনসান চৌধুরী কাছের জমিগুলো নিজের লোকজন দিয়ে চাষ করালেও দূরের জমিগুলো সেই গ্রামের লোকজনদের পত্তনি দিয়েছেন। যে বছর ফসল না হত, সে বছর ইনসান চৌধুরী নিজের লোকজন দিয়ে জোর-জুলুম করে তাদের কাছে ফসল আদায় করতেন। ফসল দিতে না পারলে গরু-বাছুর, ছাগল নিয়ে চলে আসতেন। এসব ব্যাপার ছাড়াও ইনসান চৌধুরীর মদ ও মেয়ের নেশা ছিল। তবে গ্রামের মেয়েদেরকে নিয়ে কিছু করতেন না। ঢাকা থেকে বাঈজী আনাতেন।