অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, হ্যাঁ, আপনার সব কথা সত্য। এখন আমি আমার পাপের জন্য অনুতপ্ত। তাই যা কিছু অসৎ পথে উপার্জন করেছি সব মাদরাসায় দান করতে চেয়েছিলাম। আপনিই বলুন, কিভাবে আমি পাপের প্রায়শ্চিত্য করব? কি করলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন? তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, বেশ কিছুদিন আগে আমাদের মসজিদে দরবেশের মতো একজন মুসাফির এসেছিলেন। তিনি এমন কিছু কথা আমাকে বলেছিলেন, যা শুনে আমার দিব্যচোখ খুলে যায়, দুষ্কর্মের জন্য মনে অনুশোচনা জাগে এবং মনে মনে সংকল্প করি, প্রায়শ্চিত্য করার। উনি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আরো বললেন, মানুষ জীবনে ন্যায় অন্যায় অনেক করে। সে জন্যে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। তিনি চলে যাওয়ার আগের দিন আপনার অনেক সুনাম করে আমাকে বলেছিলেন, আপনি একটা মাদরাসা করবেন, আমি যেন আপনার সঙ্গে যোগযোগ করি।
বললাম, আল্লাহ দয়ার সাগর, “যে বান্দা অন্যায় কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তাকে তিনি ক্ষমা করে দেন।” এটা কুরআন হাদিসের কথা। আপনি যখন অনুতপ্ত তখন নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করবেন। তবে আমি হাদিস মোতাবেক যে কথা বলব, তা আপনাকে করতে হবে।
আমার কথা শুনে আজিজ মিয়া যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললেন, বলুন কি করতে হবে? আপনি যা বলবেন তাই
বললাম, অসৎ পথে চৌধুরী স্টেটের যত যা কিছু নিয়েছেন, সেসব স্টেটের মালিকের কাছে ফেরৎ দিতে হবে অথবা স্টেটের মালিকের কাছে অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে এবং উনি যদি আন্তরিকভাবে ক্ষমা করে দেন, তা হলে যা কিছু আপনি মাদরাসায় দান করতে চাচ্ছেন তা আমি গ্রহণ করব। আর সে জন্য আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন ও সওয়াব দান করবেন।
উনি আবার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনার কথায় আমি রাজি। আমার শারীরিক অবস্থা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, চৌধুরী স্টেটের মালিকের কাছে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। কি করব আপনি আমাকে পরামর্শ দিন।
বললাম, ঠিক আছে, আপনার কথা আমি স্টেটের মালিকের কাছে বলব, উনি কি বলেন না বলেন আপনাকে জানাব। তারপর বিদায় নিয়ে চলে আসি।
ফায়সাল চুপ করে গেলে লুৎফা বেগম নাতনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন তুমিই চৌধুরী স্টেটের একমাত্র উত্তরাধিকারী, আজিজের ব্যাপারে তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
স্বপ্না কিছুক্ষণ চিন্তা করে নানিকে বলল, আপনি মালিক হলে কি করতেন?
লুৎফা বেগম বললেন, অপরাধী অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করা উচিত। বিশেষ করে অপরাধী যখন মৃত্যু পথের যাত্রি হয়।
স্বপ্না মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মতামত বল।
ফায়জুন্নেসার কানে মা ও মেয়ের কথা যায় নি। তিনি ম্যানেজারের মুখে আজিজের কথা শোনার পর থেকে চিন্তা করছিলেন, কে সেই মুসাফির? যে নাকি আজিজের মতো পাপীর দিব্যচোখ খুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন? তিনি কি আমার ও আজিজের কীর্তিকলাপ জানেন? আমরা চিন্তা করছিলেন, আজিজ কি তার ও আমার সম্পর্কের কথা এবং আমি তাকে দিয়ে যা কিছু করিয়েছি, সে সব ম্যানেজারকে বলেছে?
মাকে এতক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতে দেখে স্বপ্না একটু বড় গলায় বলল, মা, কি এত চিন্তা করছ? আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?
মেয়ের বড় গলায় ফায়জুন্নেসা সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন, কি জানতে গচ্ছিস?
নানি আজিজকে ক্ষমা করার কথা বললেন, তোমার মতামত জানতে চাচ্ছি।
তোর নানির সঙ্গে একমত বলে ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে জিজ্ঞেস করলেন, যে মুসাফিরের কথা শুনে আজিজের দিব্যচোখ খুলে গেছে, সেই মুসাফিরকে আপনি চেনেন?
ফায়সাল বলল, জি না, চিনি না।
তা হলে তিনি আজিজের কাছে আপনার সুনাম গাইল কি করে? তা ছাড়া আপনার মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কথাই বা জানলেন কি করে?
যে মসজিদে জুম্মার নামায পড়তে যায়, বেশ কিছুদিন আগে সেই মসজিদে দরবেশী পোশাকে অপরিচিত একজন মুরুব্বীকে দেখে কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলাম। সে সময় উনি আমার পরিচয় ও কাজ-কর্ম সম্পর্কে জেনে অনেক দোয়া করেছিলেন। তবে উনিই যে সেই মুসাফির তা বলতে পারব না। তারপর স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে ফায়সাল বলল, আজিজকে ক্ষমা করার ব্যাপারে এবার আপনার মতামত বলুন।
স্বপ্না বলল, আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন?
ফায়সাল চিন্তাই করে নি, স্বপ্না তাকে এরকম প্রশ্ন করবে। তাই থতমত খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলল, দেখুন, আমি আপনাদের একজন কর্মচারী, আমার মতামত একেবারে মূল্যহীন।
সপ্ন বলল, মূল্যহীন হোক অথবা মূল্যবান হোক, আপনি বলুন।
ফায়সাল বলল, হাদিসে পড়েছি, “আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, যাহার হাতে আমার জীবন তাঁহার শপথ, আমি যদি বড় শপথকারী হইতাম, তবে আমি তিনটি বিষয়ে শপথ করিতাম: দানে ধন কমে না; যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণে কোনো অত্যাচারীকে ক্ষমা করিয়া দেয়, আল্লাহ তাহার বিনিময়ে বিচারের দিন তাহার সম্মান বৃদ্ধি করিবেন এবং যে ব্যক্তি ভিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে, আল্লাহ তাহার জন্য দারিদ্রতার দ্বার উন্মুক্ত করেন।”[২] তবে এ কথা শরীয়ত সম্মত যে, অত্যাচারী যদি বারবার অত্যাচার চালিয়ে যায়, তা হলে তার প্রতিকার করা উচিত। এবার আপনি বলুন কি করবেন। আপনার মতামত জানার পর আজিজের সঙ্গে যোগাযোগ করব।