হ্যাঁ, নিয়েছি। ওনার মা-বাবা বা অন্য কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। দূর সম্পর্কের এক ফুপু-ওনাকে মানুষ করেছেন। ফুপুর স্বামী বা ছেলেমেয়ে কেউ নেই। একটা পুরানো তিন কামরা বাড়িতে থাকেন। আর্থিক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল। বয়স ষাটের উপর। একটা বয়স্ক কাজের মেয়ে ও একটা কাজের লোক ওনার কাছে থাকে।
তুই প্রেমের অভিনয় করে ওর সবকিছু জানার চেষ্টা করতে পারিস।
সে চেষ্টা করি নি মনে করেছ? বুঝতে পেরে এমন একটা ঘটনা শোনালেন, যা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
কি ঘটনা বলতে শুনি।
স্বপ্না ম্যানেজারের স্বপ্নে দেখা মেয়েটার ঘটনা বলে বলল, আমি যে সেই মেয়ে তা প্রমাণ করতে বললাম। ম্যানেজার আমার হাতের ও পায়ের দুটো অপারেশনের কথা ও অপারেশনের দাগ যে এখনও আছে তাও বললেন।
হাতে পায়ে তোর অপারেশন হয়েছিল কেন?
স্বপ্না সে কথা বলে বলল, ম্যানেজার আরও বললেন, স্বপ্নে আমি নাকি ওনাকে অপারেশনের দাগ দু’টো দেখিয়েছি। সব থেকে বেশি আশ্চর্য হলাম যখন বললেন, সেই মেয়েকে তিনি নিজের থেকে বেশি ভালবাসেন। মেয়েটিও তাকে ভীষণ ভালবাসে এবং স্বপ্নে মাঝে মাঝে ওনার সঙ্গে অভিসারে আসেন।
শুনে তুই কিছু বলিস নি?
বলি নি আবার? বললাম, আমি যদি আপনার স্বপ্নে দেখা সেই মেয়ে হই, তা হলে বাস্তবে আমি আপনাকে ভালবাসি না কেন? আর অভিসারই বা করছি না কেন? বললেন, খুব শিগ্রি আপনি আমাকে ভালবাসবেন এবং আমার সঙ্গে অভিসারও করবেন।
তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার গল্প শুনছি।
আমার কিন্তু তা মনে হয় নি। মনে হয়েছে, স্বপ্নের ঘটনা শুনিয়ে আমাকে সহ আমাদের সবকিছুর মালিক হতে চান।
এখন কি সে ধারণা পাল্টে গেছে?
না, পাল্টায় নি। তবে ওনার চরিত্রের দৃঢ়তা ও মাধুর্য ধারণায় ফাটল ধরাতে শুরু করেছে। যত সহজে ওনার মুখোশ খুলতে পারব ভেবেছিলাম, তা সম্ভব নয়। কোনো দিন পারব কি না তাও বলতে পারছি না। ওনার আসল স্বরূপ জানার জন্য যে পথেই অগ্রসর হই, সেই পথেই উনি প্রাচীর তুলে দেন, তাই ক্রমশ ওনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কি করব ভেবে পাচ্ছি না।
মেয়ের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে ফায়জুন্নেসা বললেন, এতে চিন্তা করার কি আছে? তোর মা হয়ে আমিই যখন ওনার স্বরূপ জানতে পারি নি, তখন তুইও যে পারবি না তা জানতাম। তাই অনেক ভেবে চিন্তে তোর নানির সঙ্গে আলাপ করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্তটা তুই কি মেনে নিতে পারবি?
সিদ্ধান্তটা আগে শুনি, তারপর বলব।
আমরা ম্যানেজারকে জামাই করতে চাই।
যেদিন ম্যানেজার স্বপ্নের মেয়েটির কথা বলে সেদিন স্বপ্না খুব রেগে গিয়ে ভেবেছিল, তাকে ক্যাপচার করার জন্য মিথ্যের জাল বিছিয়ে ফাঁদে ফেলতে চান। কি মেলামেশা করে যত ওনাকে জানছে তত নিজেই সেই ফাঁদে পড়ার জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। মায়ের কথা শুনে সেই অস্থিরতা আরো হাজারগুণ বেড়ে গেল। তাই মনকে শান্ত করার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মেয়েকে চুপ করে থাকতে দেখে ফায়জুন্নেসা বললেন, এক্ষনি মতামত জানাবার দরকার নেই, ভেবে চিন্তে জানা। তবে একথাও ঠিক, তোর অমতে আমরা কিছু করব না। এবার ঘুমোতে যা।
পরের দিন সন্ধ্যের পর ফায়জুন্নেসা ফায়সালকে ডেকে পাঠালেন।
ফায়সাল দোতলা ড্রইংরুমে ঢুকে সালাম দিয়ে দেখল, ফায়জুন্নেসা, লুৎফা বেগম ও স্বপ্না রয়েছেন।
স্বপ্না সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলল।
ফায়সাল বসার পর লুৎফা বেগম বললেন, স্বপ্নার কাছে শুনলাম কাল আজিজের লোক তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছিল। আজ সকালে যাবে তাদেরকে বলেছিলে, গিয়েছিলে নিয়?
জি, গিয়েছিলাম।
কেন ডেকেছিল।
আপনারা মাদরাসা করবেন শুনে আলাপ করার জন্য।
কি আলাপ করলেন?
উনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার কাজে বেশ কিছু টাকা দিতে চান আর মাদরাসার গরিব ছাত্রদের জন্য এতিমখানা করার জন্যও টাকা দিতে চান। শুধু তাই নয়, মাদরাসা ও এতিমখানা যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য বেশ কিছু, জমিও ওয়াকফ করে দেবেন বললেন।
মা কিছু বলার আগে ফায়জুন্নেসা রেগে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, পরের ধনে পোদ্দারী করে সওয়াব কামাতে চায়। আহা ম্যানেজার সাহেব, আপনি তো কুরআন হাদিসের অনেক জ্ঞান রাখেন, অবৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদ এরকম কাজে দান করলে কি সওয়াব পাওয়া যায়?
লুৎফা বেগম মেয়েকে ধমকের সুরে বললেন, সব জানার পরে জিজ্ঞেস করিস, ওকে কথা শেষ করতে দে। তারপর ম্যানেজারকে বললেন, আজিজের কথা শুনে তুমি কি বললে?
বললাম, শুনেছি আপনার আর্থিক অবস্থা আগে খুব খারাপ ছিল। চৌধুরী স্টেটে ম্যানেজারী করার সময় স্টেটের তহবিল তসরুফ করে ও কৌশলে স্টেটের অনেক জমি-জায়গা নিজের নামে করে নিয়ে বড়লোক হয়েছেন। আপনি মনে হয় জানেন না, এসব কাজে অসৎ পথে উপার্জিত সম্পদ দান করতে নেই। করলেও তার কোনো সওয়াব আল্লাহ দেন না। তাই জেনেশুনে ঐ সম্পদ এরকম কাজে গ্রহণ করতে আমি পারব না।
আগে হলে আমার কথা শুনে হয়তো আমাকে খুন করে ফেলতেন, কিন্তু এখন উনি একরকম মৃত্যুশয্যায়। তারপর ওনার ছেলের মৃত্যুর কথা বলে বলল, তাই একটু গীরস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এসব কথা জানলেন কি করে? বললাম, যেমন করে জানি না কেন, কথাগুলো যে সত্য, অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ এই গ্রামের মুরুব্বীরা সবাই ব্যাপারটা জানেন।