স্বপ্না তাদের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে, সুবিধে অসুবিধে জেনে তা দূর করার আশ্বাস দেয়।
একদিন সারজমিন থেকে ফেরার সময় চৌধুরী বাড়ির গেটে তিন চারজন অচেনা লোককে দারোয়ানের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে দেখে ফায়সাল দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
দারোয়ান বলল, ওরা আজিজের লোক। ভিতরে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে। আপনি বাইরে গেছেন বলা সত্ত্বেও ভেতরে যেতে চাচ্ছে।
ফায়সাল লোকগুলোকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আজিজ মিয়া। কার কাছে আপনাদেরকে পাঠিয়েছেন?
তাদের একজন বলল, চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজারের কাছে।
আমিই ম্যানেজার। বলুন, কেন পাঠিয়েছেন।
আপনি এই গ্রামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবেন শুনে সে ব্যাপারে উনি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চান। তাই আমাদেরকে পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ফায়সাল আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, উনি কেমন আছেন?
ভালো না। মাস খানেক আগে ওনার একমাত্র ছেলে সাপের কামড়ে মারা গেছেন। তারপর থেকে ওনার অবস্থা খারাপ। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন, কারো সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলেন না। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বিশেষ করে বলেছেন।
ফায়সাল বলল, মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে এল। আজ আর যাব না। আপনারা ওনাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, কাল সকাল নটার সময় আসব। তারপর লোকগুলোকে বিদায় করে ফিরে এসে স্বপ্নাকে নিয়ে গেটের ভিতরে ঢুকল।
স্বপ্না জিজ্ঞেস করল, আজিজের লোকগুলো কেন এসেছিল?
ফায়সাল বলল, আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আপনি কি বললেন?
বললাম, কাল সকালে যাব।
যাওয়াটা কি উচিত হবে?
নিশ্চয় উচিত হবে।
ওরা আমাদের শত্রু জেনেও যাবেন?
হ্যাঁ, যাব।
যদি আপনার ক্ষতি করে?
করলে করবে, তাতে আপনার কি? আপনার তো বরং খুশি হওয়ার কথা।
এমন কথা বলতে পারলেন?
কেন পারব না? আপনার কাছে আমি একজন শঠ ও ভণ্ড। ওরকম লোক খুন হলে সবাই খুশি হয়।
এই কয়েক মাস প্লা ফায়সালের সঙ্গে মেলামেশা করে তাকে যত জানছে তত যেমন মুগ্ধ হচ্ছে তেমনি তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে। তাই শক্ত আজিজের সঙ্গে দেখা করতে যাবে শুনে শঙ্কিত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেছে। ফায়সালের শেষের কথা শুনে বলল, কি আপনি তো এখানকার মানুষের কাছে মহং।
ফায়সাল বলল, মহৎ না শঠ তা আল্লাহ ভালো জানেন। এখন আর কোনো কথা নয়, নামাযের সময় হয়ে গেছে।
.
আগে লুৎফা বেগম নিজের রুমে খেতেন। স্বপ্নার জিদে মেয়ে ও নাতনির সঙ্গে খেতে হচ্ছে। আজ রাতের খাওয়ার সময় স্বপ্না বলল, আজিজ তিন চারজন লোক পাঠিয়েছিল ম্যানেজারকে নিয়ে যেতে। ম্যানেজার তাদেরকে বলেছেন, কাল সকালে যাবেন।
ফায়জুন্নেসা বললেন, তুই জানলি কি করে?
তখন আমি ওনার সঙ্গে ছিলাম।
তুই ম্যানেজারকে কিছু বলেছিস না কি?
বলেছি, আজিজ আমাদের শত্রু জেনেও যাওয়ার কথা বললেন কেন? যদি আপনার ক্ষতি করে?
শুনে ম্যানেজার কি বললেন?
বললেন, “করে করবে, তবু আমি যাব।”
আর কিছু না বলে ফায়জুন্নেসা খেতে শুরু করলেন।
স্বপ্না কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, ম্যানেজারের যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তোমাদের নিষেধ করা উচিত।
তুই করিস নি?
না।
করলেও লাভ হত না। উনি যখন যাবেন বলেছেন তখন যাবেনই।
তোমাদের কথাও শুনবেন না?
না।
স্বপ্না রেগে উঠে বলল, একজন কর্মচারী হয়ে মালিকদের কথা শুনবে না, এ কেমন কথা?
এবার লুৎফা বেগম বললেন, না শুনবেন না। কারণ আমরা আমাদের ভালো মন্দ যা বুঝি, তারচেয়ে উনি অনেক বেশি বুঝেন। তোকে তো বলেছি, আজিজ এখন আর আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে না।
স্বপ্না বলল, হঠাৎ ওনার সুমতি হল কেন?
তা বলতে পারব না। তবে মনে হয় ম্যানেজারের কারণেই হয়েছে।
আপনার এরকম মনে হল কেন?
প্রতিবছর জলমহলের মাছ ধরার সময় আজিজের লোকজন হামলা করে। এ বছর মাছ ধরার আগের দিন ম্যানেজারকে সে কথা জানাতে বললেন, আজিজ আর আপনাদের সঙ্গে শত্রুতা করবে না। তার কথার প্রমাণ পেয়ে মনে হয়েছে। ম্যানেজারকে আজিজ ডেকে পাঠিয়েছে জেনে মনে হচ্ছে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলাপ করবে।
তারপর আর কেউ কোনো কথা না বলে খাওয়া শেষ হতে লুৎফা বেগম রুমে চলে গেলেন।
ফায়জুন্নেসা মেয়েকে নিয়ে নিজের রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ম্যানেজারের ব্যাপারে কোনো কু পেয়েছিস?
স্বপ্না বলল না, পাই নি। খুব আশ্চর্য হই, যে কোনো বিষয়কে টার্গেট করে যখন ওনার শঠতা ধরার চেষ্টা করি তখন উনি সেটার এমন সুন্দর ব্যাখ্যা করেন, যা আমি চিন্তাই করতে পারি নি। আর একটা ব্যাপারেও খুব আশ্চর্য হই, আমি তার সঙ্গে কি আলাপ করব না করব, তা উনি আগের থেকে জানতে পারেন। এটা কি করে সম্ভব মাথায় ঢুকছে না। এ ব্যাপারে তুমি কিছু বলতে পার?
ফায়জুন্নেসা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বলব কি? আমার ও তোর নানির মাথায়ও এ ব্যাপারটা ঢোকে নি। তোর নানি তো একদিন ম্যানেজারকে বলেই ফেললেন, তুমি মানুষ না অন্য কিছু? তখন ম্যানেজার তোর নানির পায়ে হাত দিয়ে বললেন, এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি মানুষ?
স্বপ্না বলল, মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় উনি মানুষ নয়, অন্য কিছু।
ফায়জুন্নেসা বললেন, তোকে যে লোক পাঠিয়ে ওনার ঢাকার বাড়ির খেজ খবর নিতে বলেছিলাম, নিয়েছিস?