পীরের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে আমি বুঝতে পেরেছি; কিন্তু আট দশজন গুপ্তা ওনাকে আটকাতে পারবে না বুঝতে পারছি না।
উনি যে শুধু মারামারীতে পারদর্শী তা নয়, শত্রুকে আক্রমণ করার ও নিজেকে রক্ষা করার এত বেশি কলা কৌশল জানেন, যা নাকি আমাদের গুণ্ডাবাহিনীও জানে না।
তুমি এসব জানলে কি করে?
হাশেমের কাছে শুনেছি।
স্বপ্না হেসে উঠে বলল, হাশেম চাচা বলল আর তুমি বিশ্বাস করলে?
তুই তো আমাকে কথাটা শেষ করতে দিলি না। বলছি শোন, হাশেমের মুখে যখন শুনলাম, ম্যানেজার শত্রুদের গ্রামে গিয়েছিলেন এবং দশ বারজন গুণ্ডার সঙ্গে লড়াই করে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছেন তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম তা কি করে সম্ভব?
হাশেম বলল, আমিও বিশ্বাস করি নি। তাই ঘটনাটা সত্য কিনা জানার জন্য আমাদের গুপ্তাবাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করে সুযোগ মতো একদিন হঠাৎ ম্যানেজারকে আক্রমণ করলাম। কিন্তু আমরা কেউ ওনাকে একটাও মোক্ষম আঘাত করতে পারলাম না। বরং উনিই আমাদের সবাইকে আহত করে বললেন, আপনারা আমাকে পরীক্ষা করছেন বুঝতে পেরেছি বলে বেঁচে গেলেন, নচেৎ কি করতাম আয়াই ভালো জানেন। আমরা ওনার কাছে মাফ চাইলাম। উনি বললেন, আল্লাহ সবাইকে মাফ করুন।
এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছিস কেন কথাটা বললাম।
স্বপ্না বলল, ঠিক আছে তোমার কথা রাখার চেষ্টা করব। তারপর নিজের রুমে এসে ভাবল, এতবড় দক্ষ ফাইটার হয়েও আসার দিন যখন তার গালে চড় মারলাম তখন তো অনায়াসে হাতটা ধরে ফেলতে পারতেন অথবা প্রতিশোধ নিতে পারতেন? তা হলে এটাও কি শঠতার মধ্যে মহত্ত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু উনি তো তখন আমার পরিচয় জানতেন না? হঠাৎ তার মন বলে উঠল, তোমার মা ও নানির কাছে হয়তো তোমার কথা শুনেছে, তুমি দেখতে মায়ের মতো, তাদের কাছে তোমার আসার কথা শুনেছে, তাই অপরিচিত হলেও তোমাকে দেখেই চিনেছে। তা ছাড়া উনি তো নিজেই বলেছেন, তোমাকে অনেক দিন আগে থেকে চেনেন। কয়েকদিন চিন্তা করে স্বপ্না একটা প্ল্যান ঠিক করল। তারপর একদিন মা ও নানিকে বলল, আমি স্টেটের সবকিছুর দায়িত্ব নিতে চাই।
লুৎফা বেগম কিছু না বলে মেয়ের দিকে তাকালেন।
ফায়জুন্নেসা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, স্টেটের দায়িত্ব যেমন ম্যানেজারের উপর আছে তেমনি থাকবে, তুমি শুধু অবজার্ভ করবে।
কেন? আমার উপর তুমি কি ভরসা করতে পারছ না, না আমাকে দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত মনে করছ?
স্টেটের দায়িত্ব খুব কঠিন, যা পালন করা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভেবেছি, স্টেটের সর্বময় কর্তৃত্ব তোকে দেব। তোর কথামতো স্টেটের সবকিছু চলবে। তুই যা বলবি বা যা সিদ্ধান্ত নিবি, সবাইকে সেসব মেনে নিতে হবে। এমন কি ম্যানেজারকেও। অবশ্য স্টেটের ভালো মন্দের ব্যাপারে তোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার অধিকার ম্যানেজারের থাকবে।
স্বপ্না নানিকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি কিছু বলবেন না?
লুৎফা বেগম বললেন, আমি তোর মায়ের সঙ্গে একমত। তারপর মেয়েকে বললেন, মসজিদ মাদরাসার ব্যাপারটা স্বপ্নাকে জানাও।
ফায়জুন্নেসা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছুদিন আগে ম্যানেজার আমাদের গ্রামে মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলেছিলেন। ইদানিং বার বার তাগিদ দিচ্ছেন। আমি মসজিদ ও মাদরাসা কিভাবে পরিচালিত হবে জিজ্ঞেস করতে বললেন, মসজিদের খরচ কম, তাই মসজিদের নামে একটা জল মহল ওয়াকফ করে দিলে সেটার আয়ে চলবে। মাদরাসার খরচ বেশি, সেজন্য বাকি চারটে জলমহল মাদরাসার নামে ওয়াকফ করে দিলে সেগুলোর আয়ে মাদরাসা চলবে। আর মসজিদ ও মাদরাসা পরিচালনা করার জন্য একটা কমিটি থাকবে। কমিটির সদস্যরা মসজিদ, মাদরাসা ও জলমহলের আয় ব্যয়ের হিসাব রাখবে।
স্বপ্না শুনে খুব রেগে গেল। রাগ সামলে নিয়ে বলল, তোমরা কি ম্যানেজারের কথা মেনে নিয়েছ?
হ্যাঁ, মেনে নিয়েছি।
খুব আশ্চর্য হচ্ছি, ম্যানেজার যা বলেন মেনে নাও, এর কারণ কি বলবে?
এবার লুৎফা বেগম বললেন, বর্তমান ও ভবিষ্যতের চৌধুরী বংশধরদেরকে জিনেদের আক্রোশ হতে রক্ষা করার জন্য।
স্বপ্না রাগের সঙ্গেই বলল, আপনাকে আগেও বলেছি আর এখনও বলছি, ওসব আগের যুগের অশিক্ষিত মানুষের মনগড়া কথা। শুধু আমি কেন, এখন কোনো শিক্ষিত মানুষ এসব বিশ্বাস করে না। মৃণালবাবুর কাছে জেনেছি, ঐ পাঁচটা জলমহল থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হয়। ওয়াকফ করে দিলে আমরা ঐ টাকা থেকে বঞ্চিত হব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ম্যানেজার নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য জিনেদের কথা বলে মসজিদ মাদরাসা করতে চাচ্ছেন।
ফায়জুন্নেসা কিছু বলার আগে লুৎফা বেগম বললেন, আমরা ম্যানেজারকে অনেক ভাবে পরীক্ষা করে বিশ্বাস করেছি। তাই ওনার কথামতো ঐসব করতে রাজি হয়েছি। তবে ফাইন্যাল কিছু হয় নি। ফাইন্যাল হওয়ার আগে ওনাকে কেন তুই বিশ্বাস করতে পারছিস না এবং কেন ওনাকে ধূর্ত ও শঠ মনে করছি, তার প্রমাণ দেখাবি। তারপর তোকে স্টেটের সর্বময় কর্তৃত্ব দেয়া হবে।
স্বপ্না বলল, কিন্তু তার আগেই তো লক্ষ লক্ষ টাকা আয়ের জলমহলগুলো আপনারা ওয়াকফ করে দিচ্ছেন?
তাতে কি হয়েছে? জল মহলগুলো ছাড়াও চৌধুরী স্টেটের আয় কম না। তোর পূর্ব পুরুষরা অত্যাচার করে ভাগ চাষিদের কাছ থেকে যত না ফসল পেত, ম্যানেজার অত্যাচার না করে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে তার থেকে অনেকগুন বেশি ফসল আদায় করছেন। তুইও যদি ম্যানেজারের মতো সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিস, তা হলে আরও বেশি ফসল পাবি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের লোকেরা চৌধুরী স্টেটের মালিকদের ভয়ে তটস্থ থাকত, আর এখন এই ম্যানেজারকে তারা পীরের মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তুই যদি ম্যানেজারের পথ অনুসরণ করতে পারিস, তা হলে তোকেও সবাই ওনার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। আমার আর কিছু বলার নেই। কথা শেষ করে লুৎফা বেগম নিজের রুমে চলে গেলেন।