স্বপ্না চিন্তা করল, ম্যানেজার ধর্মের মুখোশ পরে আজিজের মতো আখের গোছাবার তালে নেই তো? যদি তাই হয়, তা হলে বাছাধনকে জেলের ঘানি টানাব।
লুৎফা বেগম বললেন, কি রে, কি ভাবছিস?
না, তেমন কিছু না, শুনেছি, ম্যানেজার ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন, কবে ফিরবেন?
তুই যেদিন এলি, ঐদিন পনের দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে।
ওনার বাড়ি কোথায়?
ঢাকায়।
আচ্ছা, ওনাকে কি আমাদের পূর্ব পুরষদের কথা আপনারা বলেছেন?
না।
আমার মনে হয়, উনি কারো কাছ থেকে সবকিছু জেনেছেন। ঠিক আছে, আসার পর আমি আলাপ করে দেখব, কতটা ভালো।
স্বপ্না প্রায় প্রতিদিন হাশেমের সঙ্গে স্টেটের সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।
একদিন তাকে জিজ্ঞেস করল, ম্যানেজার কেমন লোক বলতে পার?
হাশেম বলল, ওনার মতো ভালো ছেলে আমি জীবনে দেখি নি।
স্বপ্না মনে করেছিল ম্যানেজার বয়স্ক লোক। হাশেম হেলে বলতে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ম্যানেজারকে ছেলে বলছ কেন? উনি বয়স্ক লোক না?
না মা, ওনার বয়স বড় জোর আঠাশ কি ত্রিশ।
তাই না কি?
শুধু তাই নয়, দেখতেও খুব সুন্দর। যেমন রঙ তেমনি স্বাস্থ্য। তা ছাড়া উনি সবদিকে এক্সপার্ট।
সবদিকে এক্সপার্ট মানে?
মানে, উনি সব ধরনের মারামারীতে খুব পটু। ধর্মের আইন নিজে যেমন মেনে চলেন, অন্যদেরকেও মেনে চালাবার চেষ্টা করেন। আর কি অমায়িক ব্যবহার। গ্রামের গরিব-বড়লোক, ছোট-বড় সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন।
সবার মুখে ম্যানেজারের প্রশংসা শুনে স্বপ্নার সু ধারণা হল, ম্যানেজার কারো কাছ থেকে চৌধুরী বংশের খোঁজ খবর নিয়ে রাজকন্যাসহ রাজত্ব পাওয়ার আশায় এখানে এসেছে এবং ধর্মের মুখোশ পরে সকলের মন জয় করেছে।
একদিন অফিসের বড়বাবু মৃণালবাবুর সাহায্যে ম্যানেজারের খাতাপত্র চেক করতে লাগল। পাঁচ দু’দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কারচুপির কোনো প্রমাণ না পেয়ে ভাবল, এটাও ম্যানেজারের একটা চাল।
.
চৌদ্দ দিন ছুটি কাটিয়ে আজ রাত আটটার সময় ফায়সাল কর্মস্থলে ফিরে এল।
নটার সময় আকলিমা রাতের খাবার নিয়ে এসে বলল, আপনি যে দিন বাড়ি গেলেন, ঐদিন মালেকিনের মেয়ে বিদেশ থেকে এসেছেন।
ফায়সাল কিছু না বলে খেতে বসল।
আকলিমা মনে করেছিল, তার কথা শুনে ম্যানেজার খুশি হয়ে ওনার সম্পর্কে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করবেন। চুপচাপ খেতে দেখে আবার বলল, লেখাপড়া করার জন্য ওনার বাবা সাত বছর বয়সে ঢাকায় নিয়ে………
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ফায়সাল বলল, ওনার কথা বলার দরকার নেই, আমি সব জানি।
আকলিমা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। ফায়সালের খাওয়া হয়ে যেতে বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেল।
পরের দিন ফায়সাল অফিসে কাজ করছিল। হঠাৎ দরজার দিকে তাকাতে স্বপ্নাকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসুন।
স্বপ্না ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচয় করার জন্য কিছুক্ষণ আগে এসে ফায়সালকে চিনতে পেরে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, আসার দিন তা হলে ইনারই গালে চড় মেরেছে। ফায়সাল তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করল। তারপর প্রথমে ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, সেদিনের ঘটনায় আমি কিছু মনে করি নি। প্লীজ, ভিতরে এসে বসুন।
স্বপ্না ভিতরে এসে ফায়সালের সামনের চেয়ারে বসল।
ফায়সাল বসে বলল, আমি কিন্তু আপনাকে সালাম দিয়েছি।
আমি যেখানে মানুষ হয়েছি, তারা সালাম কি ও কেন শেখায় নি।
তা হলে আমি শেখাই?
না, প্রয়োজন হলে নিজেই শিখে নেব।
ঠিক আছে, কিছু বলার থাকলে বলুন।
বলতে আসি নি, পরিচয় করতে এসেছি।
মাফ করবেন, কথাটা ঠিক বলেন নি।
স্বপ্না রাগের সঙ্গে বলল, মানে?
মানে, এখানে আসার পর আপনার পরিচয় আমি যেমন জানি, আপনিও তেমনি জানেন। শুধু আমাকে দেখার বাকি ছিল। তাই দেখতে এসেছেন।
এবার স্বপ্না রাগের পরিবর্তে অবাক হল, জিজ্ঞেস করল, আপনার বাকি ছিল?
আপনাকে আমি অনেক দিন আগে থেকে দেখে আসছি। শেষবারে দেখেছি পনের দিন আগে বাড়ি যাওয়ার সময় রাস্তায়।
স্বপ্না আরো অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে রাগের সঙ্গে বলল, মিথ্যের বেড়াজাল বিছিয়ে এখানকার সবাইকে ধোকা দিতে পারলেও আমাকে পারবেন না। জানেন না, মিথ্যে দিয়ে সত্যকে বেশি দিন ঢেকে রাখা যায় না?
কেন জানব না? আর জানি বলেই কখনও মিথ্যা বলি না, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কোনো কাজও করি না।
তা হলে কেন বললেন, আমাকে অনেক দিন থেকে দেখে আসছেন?
কথাটা সত্য, তাই বলেছি।
কোথায় দেখেছেন?
মাফ করবেন এখন বলা সম্ভব নয়।
কখন সম্ভব হবে?
সময় মতো আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
তার কথা শুনে স্বপ্না খুব রেগে গেল। রাগ সামলাবার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, আমাকে যদি অনেক দিন থেকে দেখে থাকেন, তা হলে সে দিন রাস্তায় অভদ্রের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
মাফ করবেন, সে কথাও বলা এখন সব নয়।
এবার আর স্বপ্না রাগ সামলাতে পারল না। কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আমাকে চেনেন?
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, “সাত খণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসি।” আপনার প্রশ্নটা সে রকম হয়ে গেল না?
সাট আপ, যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দিন।
চিনব না কেন? আপনি মরহুম ইনসান চৌধুরীর নাতনি জেবুন্নেসা ওরফে স্বপ্না। যিনি চৌধুরী বংশের একমাত্র প্রদীপ ও চৌধুরী স্টেটের একমাত্র উত্তরাধিকারী।