স্বপ্নার কথা ফায়সালের কানে গেল না। কয়েক বছর ধরে যে মেয়েকে স্বপ্নে দেখে আসছে, সেই মেয়ে আজ তার সামনে। তাই বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
স্বপ্না চৌধুরী বংশের মেয়ে না হলেও নাতনি। তার রক্তে চৌধুরী বংশের রক্ত। তাই ছেলেটাকে একইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও তার কথার উত্তর না পেয়ে আরো রেগে গেল। এগিয়ে এসে ফায়সালের গালে কষে একটা চড় মেরে বলল, অভদ্রদেরকে এইভাবে ভদ্রতা শেখাতে হয়।
স্বপ্নার চড় খেয়ে ফায়সাল বাস্তবে ফিরে এল। যন্ত্রণা অনুভব করে গালে হাত বুলোত বুলোতে রিকশাওয়ালাকে বলল, রিকশা রাস্তা থেকে জমিতে নামাও।
রিকশাওয়ালা ঘটনাটা দেখেছে। তাই কিছু না বলে রিকশা রাস্তা থেকে জমিতে নামাল।
ততক্ষণে স্বপ্না গাড়িতে উঠে বসেছে। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়ি চলে যাওয়ার পর রিকশাওয়ালা ফায়সালকে বলল, আমি একা রিকশা রাস্তায় তুলতে পারব না, আপনিও ধরুন।
রাস্তায় রিকশা তোলার পর ফায়সাল উঠে বসল।
রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে চালাতে বলল, একটা মেয়ে আপনার গালে চড় মারল আর আপনি তাকে কিছু না বলে তার গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন? ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না, আমি হলে বলে থেমে গেল।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, কি করতেন? তার গালে আপনিও চড় মারতেন?
হ্যাঁ, মারতামই তো। মেয়ে হয়ে যদি ছেলের গালে চড় মারতে পারে; তা হলে ছেলে হয়ে পারতাম না কেন?
মেয়েরা যা করতে পারে সবক্ষেত্রে ছেলেরা তা পারে না।
এটা আপনি ঠিক বলেন নি, বরং মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি পারে।
তাই যদি হয়, তা হলে মেয়েরা সন্তান পেটে ধরতে পারে, ছেলেরা পারে না
এই কথা শুনে রিকশাওয়ালা থতমত খেয়ে গেল। কোনো উত্তর দিতে পারল না।
ফায়সাল বলল, এখন বুঝলেন তো, ছেলে হোক আর মেয়ে হোক সবাই সব কাজ করতে পারে না।
রিকশাওয়ালা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
স্বপ্না ছেলেবেলায় মায়ের তেমন আদর যত্ন পাই নি। চাকরানি তাসলিমা তাকে দেখাশোনা করত। এমন কি তার কাছেই ঘুমাত। তাই মায়ের প্রতি তার তেমন টান ছিল না। বরং মাকে ভয় করত। তাই বাবা যখন তাকে ঢাকায় এনে হোমে রেখে যায় তখন মায়ের জন্য মন খারাপ হয় নি। তারপর বড় হয়ে যখন জ্ঞান হল তখন মা তাকে একবারও দেখতে আসে নি বলে মায়ের উপর প্রচণ্ড অভিমান হয়। সেজন্যে বাবা এলে তাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করত না। এমন কি বাবা মারা যাওয়ার পর নানি লুৎফা বেগম যখন চিঠি দিয়ে সে কথা জানাল। তখন বাবার জন্য অনেক কান্নাকাটি করলেও বাড়িতে আসে নি এবং মায়ের কথাও নানিকে জানাতে বলে নি। তারপর নানির সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ থাকলেও মাকে কোনো চিঠি দেয় নি। অবশ্য মাঝে মধ্যে মাকে চিঠি দিয়ে ও বাড়িতে গিয়ে তার খবর নেয়ার খুব ইচ্ছা হত। তাই একবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য লোক পাঠাতে নানিকে জানিয়েছিল। উত্তরে লুৎফা বেগম জানিয়েছিলেন, লেখাপড়া শেষ করে আসবি। তোর বাবাও আমাকে সে কথা বলেছিল। তাই নানির চিঠি পাওয়ার পর মাকে চিঠি দেয়ার ও বাড়িতে আসার চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলেছিল। আমেরিকা যাওয়ার সময় এয়ারপোর্টে প্রায় পনের ষোল বছর পর নানিকে ও মাকে দেখে সে সময় মায়ের আচরণে বেশ অবাক হয়ে ভেবেছিল, যে মা আজ এত বছর মেয়ের খোঁজ খবর রাখে নি, এক বারের জন্যে দেখতেও আসে নি, এমন কি একটা চিঠি পর্যন্ত দেয় নি, সেই মা তাকে আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসার জন্য চোখের পানি ফেলে আকুতি মিনতি করছে কেন? তখন অভিমানে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায় নি। নানির কথায় অভিমান ধরে রাখতে পারে নি এবং আমেরিকায় গিয়ে মায়ের সঙ্গে চিঠি দেয়া-নেয়া করে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জন্মেছে। তারপর বাড়িতে এসে মা ও নানির স্নেহ ও ভালবাসায় আপ্লুত হয়েছে।
একদিন লুৎফা বেগম চৌধুরী বংশের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস ও ওনাদের করুন মৃত্যুর কথা নাতনিকে বললেন।
স্বপ্না পূর্ব পুরুষদের মৃত্যুর ঘটনা শুনে দুঃখ পেলেও জিনেদের ব্যাপারটা বিশ্বাস করল না। বলল, ওসব কল্প কাহিনী।
লুৎফা বেগম বললেন, আমি এ বাড়ির বৌ হয়ে এসে আমার শাশুড়ি যখন আমাকে এসব কথা বলেছিলেন তখন আমিও বিশ্বাস করি নি। তারপর ওনার শাশুড়ি যা কিছু বলেছিলেন, সেসব বলে বললেন, তুই চৌধুরী বংশের একমাত্র প্রদীপ। তোকে নিয়ে আমি ও তোর মা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তবে এখন আল্লাহ আমাদেরকে সেই চিন্তা থেকে নিকৃতি দিয়েছেন।
স্বপ্না কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করল, কি ভাবে?
আমাদের স্টেটের ম্যানেজার নিজের থেকে একদিন আমাদেরকে বললেন, আপনারা স্বপ্নার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। পূর্ব পুরুষদের মতো ওনার জীবনে কিছু ঘটবে না।
স্বপ্না হেসে উঠে বলল, ম্যানেজার বললেন আর আপনারা ওনার কথা বিশ্বাস করে ফেললেন? আসলে কি জানেন নানি, ওসব কথা উনিও বিশ্বাস করেন নি। তাই নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
তোর কথা ঠিক নয়। ম্যানেজার খুব ধার্মিক। এখানে জয়েন করার কিছু দিনের মধ্যে এ বাড়ির পরিবেশ পাল্টে দিয়েছে। ছোট বড় সবাইকে আপনি করে বলে। এমন কি চাকর-চাকরানিদেরকেও। সবাইকে তালিম দিয়ে নামায ধরিয়েছে। তোর মাও নামায পড়ত না। গতকাল থেকে পড়ছে। আর সেটা ম্যানেজারের কারণেই। আজিজের সঙ্গে আমাদের শত্রুতার কথা তোকে তো বলেছি। সেই আজিজকেও মিত্র বানিয়েছে। এখনও এক বছর হয় নি ম্যানেজার হয়ে এসেছে, এর মধ্যে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। উপযাজক হয়ে সেই ছেলে আমাদেরকে মিথ্যে প্রবোধ দেবে, তা হতে পারে না।