অন্যান্য ভাইয়েরাও তাই করেছেন?
হ্যাঁ।
বাহ! খবু ভালো কথা তো? এরকম কথা কখনও না শুনলেও এটা ইসলামের কথা।
ততক্ষণে তারা চৌধুরী বাড়ির গেটে পৌঁছে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, নামুন, এটাই চৌধুরী বাড়ি।
গেটের উপর একটা বাল্ব জ্বলছিল। তার আলোতে ফায়সাল দেখল, অনেক পুরানো বেশ বড় লোহার গেট। ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে। তাই চারপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না।
রিকশাওয়ালা অধৈর্য গলায় বলল, কই নামুন। আমাকে এতটা পথ ফিরে যেতে হবে।
ফায়সাল একটা ব্রিফকেসে কাপড় চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। সেটা নিয়ে রিকশা থেকে নেমে বলল, গেট তো বন্ধ।
রিকশাওয়ালা বলল, ভিতরে দারোয়ান আছে, ডাকলে খুলে দেবে।
রিকশা বিদায় করে ফায়সাল গেটের কাছে গিয়ে বলল, কে আছেন, গেট খুলুন।
দুতিনবার বলার পর ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে?
আমি ঢাকা থেকে এসেছি, গেট খুলুন।
আপনাকে কি আসতে বলা হয়েছিল?
হ্যাঁ।
নাম বলুন।
ফায়সাল আহম্মদ।
একটু অপেক্ষা করুন।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর দারোয়ান গেট খুলে দিতে ফায়সাল ভিতরে ঢুকল।
দারোয়ান তার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, আসুন আমার। সঙ্গে। তারপর যেতে যেতে বলল, আপনার তো গতকাল আসার কথা ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
গেট থেকে বাড়িটা বেশ দূরে। দোতলার বারান্দার কার্নিশে আড়াইশ পাওয়ারের বাল্বের আলোতে ফায়সাল দেখতে পেল, দোতলা পাকা বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেক খানি ফাঁকা জায়গা। সেখানে বিভিন্ন তরি-তরকারির চাষ করা হয়েছে। পাঁচিলের গা ঘেঁষে সারি সারি অনেকগুলো কাঁচা ঘর।
দারোয়ান তাকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসে বলল, আপনি বসুন, মালেকিন কিছুক্ষণের মধ্যে আসবেন। কথা শেষ করে চলে গেল।
ফায়সাল একটা সোফায় বসে ব্রিফকেসটা পাশে রেখে চারপাশে চোখ বোলাল, মেঝেয় দামি কার্পেট বিছান, সোফাসেট ও অন্যান্য সব কিছু অত্যাধুনিক। তিন পাশে দেয়ালে বাংলাদেশের কয়েকজন মনীষীর বাঁধানো ছবি। আর ভিতরে যাওয়ার দরজার উপরে দেয়ালে ত্রিশ ও পয়ত্রিশ বছরের যুবক যুবতীর ওয়েল পেন্টিং। একটা চার পাঁচ বছরের ফুটফুটে মেয়ে যুবতীর হাত ধরে রয়েছে। যুবতীর ফটোতে তার চোখ আটকে গেল। এই অপূর্ব সুন্দরীকে প্রায় মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখে। তাই তার মুখের ছবি আজও মনে গেঁথে আছে। ভালো করে দেখে তার মনে হল, ফটোর মেয়েটি স্বপ্নে দেখা মেয়েটির বড় বোন অথবা মা। তারপর চার পাঁচ বছরের মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে মনে হল, স্বপ্নে দেখা মেয়েটির ছোটবেলার ফটো। এমন সময় ঠক ঠক শব্দ শুনে সেদিকে তাকাতে দেখল, দেয়ালে টাঙ্গানো যুবতী মেয়েটা তার সামনের সোফায় বসে টেবিলে পেপার ওয়েট ঠুকে শব্দ করছে। তবে ফটোর মেয়েটির থেকে এই মেয়েটির বয়স বেশি। তবু খুব অবাক হয়ে সালাম জানাতে ভুলে একবার ফটোর মেয়েটার দিকে আর একবার সোফায় বসা মেয়েটির দিকে তাকাতে লাগল।
২. পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি
ইনসান চৌধুরী পৈত্রিক সূত্রে বিশাল সম্পত্তি পেয়েছেন। কয়েকটা জলমহল ছাড়াও কয়েকশ বিঘে ফসলী জমি, কয়েকটা বাগান ও প্রায় পনের বিশটা বড় বড় পুকুর ওনার দাদা জয়নুদ্দিন খরিদ করেছিলেন। কিংবদন্তী আছে, জয়নুদ্দিনের বাড়ি ছিল ডোমার। তিনি একজন দরিদ্র কৃষক ছিলেন। সব দিন ঘরে অন্ন জুটত না। অভাবের তাড়নায় এক গভীর রাতে একটা দীঘিতে জাল ফেলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। সারা রাত জাল ফেলে একটা মাছও জালে পড়ে নি। ফজরের আযানের সময় হতাশ হয়ে শেষবারের মতো জাল ফেলে যখন টানতে শুরু করেন তখন এত ভারি মনে হতে লাগল, যেন জাল ছিঁড়ে যাবে। অনেক কষ্টে জাল তুলতে সক্ষম হন। দেখলেন, একটা পিতলের কলসি জালে উঠেছে। কলসিতে কি আছে দেখার সময় পেলেন না, আযান শুনে সকাল হয়ে গেছে জেনে কাসিটা জালে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে এসে ঢাকনা খুলে সোনার মোহর দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। স্নান ফিরে পেয়ে দেখলেন তার বৌ মাথায় পানি দিচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে কলসি দেখতে না পেয়ে বৌকে জিজ্ঞেস করলেন, পিতলের কলসি কোথায়?
সায়রা বানু বললেন, আস্তে কথা বল, বাতাসেরও কান আছে। কলসিতে সোনার মোহর দেখে ঘরের মেঝেয় পুঁতে রেখেছি। তখন তাদের একমাত্র সন্তান আবসার উদ্দিন তিন বছরের। গ্রামের লোকজন জেনে যাওয়ার ভয়ে স্ত্রী, ছেলে ও সব সোনার মোহর নিয়ে খোকসাবাড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে এই সব সম্পত্তি করে চৌধুরী উপাধি গ্রহণ করেন। আবসার উদ্দিন যখন কলেজে পড়েন তখন একদিন জয়নুদ্দিনের খোঁজ পাওয়া গেল না। তিন চার দিন পর লোকজন ওনার লাশ একটা জলমহলে ভাসতে দেখে তাদের বাড়িতে খবর দেয়।
ধনী হিসাবে জয়নুদ্দিনের নাম আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। থানার পুলিশদের সঙ্গে ওনার দহরম-মহরম ছিল। তারা লাশ ময়না তদন্ত করার জন্য নীলফামারী হাসপাতালে নিয়ে গেল। ময়নাতদন্তে জানা গেল, গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে।
এরকম একজন ধনী ও গণ্যমান্য লোককে কেউ গলাটিপে মারবে, গ্রামের লোক বিশ্বাস করতে পারল না। তাদের ধারণা জিনেদের সোনার মোহরের কলসি নিয়ে জয়নুদ্দিন ডোমার থেকে পালিয়ে এসেছিলেন বলে তারা ওনাকে গলাটিপে মেরে জলমহলে ফেলে দিয়ে গেছে।