না।
কেন মা?
সে কথা এখন বলতে পারব না।
ফায়জুন্নেসা মাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, তা হলে এক কাজ করলে হয় না, আমরা ঢাকায় গিয়ে হোটলে থেকে আমেরিকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে আমাদের সঙ্গে রাখব?
না, তাও সম্ভব নয়। ও যেখানে থাকে সেখানকার সুপার অনুমতি দেবেন না।
আমি মা, আমি বললেও অনমতি দেবেন না?
না, দেবেন না। তা ছাড়া এত বছর মেয়ের খোঁজ খবর রাখিস নি, এখন মা বলে পরিচয় দিলেও স্বপ্না তোর সঙ্গে দেখা করবে বলে মনে হয় না। এয়ারপোর্ট ছাড়া তার সঙ্গে কিছুতেই তোর দেখা হওয়া সম্ভব নয়। তাই যা বলছি শোন, আমেরিকায় পড়াশোনা শেষ করে ওর এখানে ফিরে আসার কথা। এর মধ্যে তুই চিঠি দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবি। তুই তো শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী, চিঠিতে এমন কিছু লিখবি, যাতে সে ফিরে আসে।
যদি ফিরে না এসে ওখানে থেকে যায়?
আমাকে কথা দিয়েছে ফিরে আসবে। তবে আমি যদি মরে যাই, তা হলে কি করবে বলতে পারছি না। চৌধুরী বংশের শেষ প্রদীপ প্লা। সে যাতে চৌধুরী স্টেটের হাল ধরতে পারে, সেজন্য হারেস তাকে সেইভাবে মানুষ করার ব্যবস্থা করেছিল। হারেস নেই, এখন তাকে ফিরিয়ে এনে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া তোর কর্তব্য।
আমেরিকা যাওয়ার দিন এয়ারপোর্টে স্বপ্নার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর অল্প সময় আলাপ করার সুযোগ পেয়েছিলেন ফায়জুন্নেসা। সে সময় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মেয়েকে বলেছিলেন, মানুষ মাত্রই ভুল করে, তবে আমি হয়তো গুরুতর ভুল করেছি। সেজন্যে মা হয়ে তোর কাছে ক্ষমা চাইছি। বল মা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস? পড়াশোনা শেষ করে ঘরে ফিরে আসবি বল?
পরিচিত হওয়ার পর থেকে স্বপ্না একটা কথাও বলল না, শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। মার ক্ষমা চাওয়া ও ঘরে ফেরার কথা শুনেও কিছু বলল না, একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
লুৎফা বেগম নাতনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিছু বলছিস না কেন? তুই বোধ হয় জানিস না, আল্লাহ ও রসুল (দঃ) এর পরেই মা বাবার স্থান। মায়ের স্থান পিতার উর্বে স্থাপন করা হয়েছে। হাদিসে আছে, “এক ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (দঃ) কে জিজ্ঞাসা করিল, সন্তানের উপর তাহার পিতা-মাতার কি হক (দাবি) আছে? তিনি বলিলেন, তাহারা উভয়েই তোমার বেহেশত ও তোমার দোয়োখ।”[১]
সন্তানের কর্তব্য বিদেশ যাওয়ার সময় মা-বাবার অনুমতি নেয়া। তোর বাবা নেই, এখন মা-ই তোর মা-বাবা। মনে রাখিস, মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে কেউ জীবনে সুখী হতে পারে না। মা-বাবার ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখাও সন্তানের কর্তব্য। এখন তোর উচিত মাকে ক্ষমা করে দিয়ে তার অনুমতি নেয়া ও তার কথার উত্তর দেয়া।
দীর্ঘ পনের ষোল বছর মা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে নি বলে স্বপ্নার মনে রাগ ও অভিমানের পাহাড় জমে ছিল। তাই এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি। নানির কথা শুনে সেই রাগ ও অভিমান কপূরের মতো উড়ে গেল। মা বলে ফায়জুন্নেসাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে লাগল।
এতবছর পর মা ডাক শুনে ফায়জুন্নেসাও চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। ভিজে গলায় বললেন, বল মা, লেখাপড়া শেষ করে তুই আমার কোলে ফিরে আসবি?
স্বপ্না সামলে নিয়ে চোখ মুখ মুছে প্রথমে নানিকে ও পরে মাকে কদমবুসি করে বলল, হ্যাঁ মা ফিরে আসব। এবার তুমি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দাও।
এরপর থেকে ফায়জুন্নেসা প্রতি মাসে মেয়েকে চিঠি দেন। স্বপ্নাও চিঠির। উত্তর দেয়। মাস তিনেক আগে দেশে ফেরার কথা জানালেও নানি ও মাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কবে ফিরবে জানায় নি।
.
বাসের চেয়ে ট্রেনের জার্নি আরামদায়ক। তাই ফায়সাল ট্রেনে যাতায়াত করে। নীলফামারী থেকে ট্রেনে রংপুর এসে ঢাকার ট্রেনে উঠতে হয়। ঐ ট্রেন ছাড়ে সন্ধ্যে সাতটায়। তাই ফায়সাল ঐদিন সকালে রওয়ানা না হয়ে বিকেল পাঁচটায় চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরোল।
এদিকে রিকশা খুব কম চলাচল করে। তবে মাইল দুয়েক দূরে একটা বাজার আছে, ওখানে সব সময় রিকশা পাওয়া যায়। আজ ভাগ্যগুণে কিছুদূর আসার পর পিছন থেকে আসা একটা খালি রিকশা পেয়ে গেল।
বাজারের কাছাকাছি এসেছে এমন সময় সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি আসতে দেখে রিকশাওয়ালাকে ফায়সাল সাইড দিতে বলল।
রিকশাওয়ালা বলল, দেখছেন না, সাইড দেয়ার মতো রাস্তাটা চওড়া নয়?
ফায়সাল চিন্তিত হয়ে বলল, তা হলে এখন কি হবে?।
রিকশাওয়ালা বলল, কি আবার হবে? গাড়ির ড্রাইভারকে ব্যাক গিয়ারে বাজারে যেতে হবে।
কিছুটা দূর থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভার হর্ণ বাজাচ্ছিল। সাইড না পেয়ে রিকশার সামনে এসে ব্রেক করে বলল, সাইড দেয়ার জন্য আগের থেকে হর্ণ বাজালাম, তুমি সুবিধে মতো জায়গায় দাঁড়াতে পারতে।
রিকশাওয়ালা বলল, সাইড দেয়ার মতো জায়গা থাকলে তো দাঁড়াব। বাজার কাছেই, ওখানে সাইড দেয়ার জায়গা আছে, আপনি ব্যাক গিয়ারে বাজারে চলুন।
রিকশাওয়ালার কথা শুনে ড্রাইভার রেগে গেল। সামনের রাস্তার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কি করবে জানার জন্য পিছনে বসা প্যাসেঞ্জারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
ততক্ষণে ফায়সাল রিকশা থেকে নেমে পিছনের সিটে স্বপ্নে দেখা সেই মেয়েটিকে দেখে অবাক হয়ে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
স্বপ্না আজ ভোরে ঢাকায় পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে বাড়ি আসছে। ড্রাইভারের তাকানর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে রিকশাওয়ালার কথা যাচাই করার জন্য গাড়ি থেকে নামতেই ফায়সালের চোখে চোখ পড়ে গেল। তাকে ঐভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুব রেগে গেল। বলল, আপনার কি ভদ্ৰতা জ্ঞানও নেই? দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রঘরের ছেলে।