এবার যাওয়ার অনুমতি দিন বলে ফায়সাল দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ভুলেও আপনার মেয়েকে এসব কথা জানাবেন না। তারপর লুৎফা বেগম কিছু বলার আগেই সালাম দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
ফায়জুন্নেসা ঘুম থেকে উঠেন আটটায়। আজ উঠে কুলসুমের মুখে ম্যানেজার ফিরেছে শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর নাস্তা খেয়ে নিচতলার ড্রইংরুমে এসে ফায়সালকে ডেকে পাঠালেন।
ফায়সাল এসে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে ফায়জুন্নেসা বসতে বলে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনার মতো ছেলে এরকম একটা কাজ করবেন ভাবতেই পারি নি।
ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন।
কোথায় ছিলেন এই কদিন।
ফায়সাল যে কথা লুৎফা বেগমকে বলেছিল, সে কথা বলল।
কাজটা কি?
মাফ করবেন, বলতে পারব না।
আমার স্টেটের কাজ, বলতে পারবেন না কেন?
ফায়সাল মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।
কি হল উত্তর দিচ্ছেন না কেন?
দয়া করে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। পরে আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
ফায়জুন্নেসা রেগে গেলেও সংযত কণ্ঠে বললেন, কোথায় গিয়েছিলেন, ঢাকায়?
মাফ করবেন, তাও বলতে পারব না।
ফায়জুন্নেসা রাগ সহ্য করতে পারলেন না। কড়া স্বরে বললেন, আপনি কি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
সেজন্য আবার মাফ চাইছি।
যা আরো রেগে উঠে ফায়জুন্নেসা বললেন, আপনি শিক্ষিত ছেলে হয়ে মালিকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কত বড় অন্যায় করছেন বুঝতে পারছেন না?
তা পারব না কেন? একটা সত্য ঘটনা বলছি শোনেন, খলিফা হারুণ-অর রশিদ একদিন খাওয়ার পর চিলিমচিতে হাত ধুচ্ছিলেন, একজন ক্রীতদাস ওনার হাতে পানি ঢালছিল। হঠাৎ হাত ফসকে পানির পাত্রটা চিলিমটিতে পড়ে যায়। চিলিমচির পানি খলিফার চোখে মুখে ছিটকে পড়ে। খলিফা ভীষণ রেগে উঠে ক্রীতদাসের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। ক্রীতদাস জানে এই অপরাধের জন্য খলিফা তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। এমন কি মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারেন। সে ছিল আল্লাহর ঈমানদার বান্দা। আর ঈমানদার বান্দারা কোনো শাস্তি বা মৃত্যুকে ভয় করে না। তাই খলিফা অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে বলল, আল্লাহ রাগকে দমন করতে বলেছেন। আর আমাদের নবী করিম (দঃ) বলিয়াছেন, “ক্রোধ প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তাহা হজম করে, বিচারের দিন আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টি জীবকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে যে-কোনো হুর পছন্দ করিয়া লইতে বলিবেন।”[৯]
ক্রীতদাসের কথা শুনে খলিফা মুচকি হেসে বললেন, তোমাকে মাফ করে দিলাম।
ক্রীতদাস আবার বলল, অপরাধীকে যারা ক্ষমা করেন তাদেরকে আল্লাহ ও তার রসুল (দঃ) ভালবাসেন।
এবার খলিফা বললেন, যাও, তোমাকে আযাদ করে দিলাম।
গল্পটা শুনে ফায়জুন্নেসার রাগ পড়ে গেল। বললেন, ঠিক আছে, মাফ করে দিলাম। তবে ভবিষ্যতে এভাবে না জানিয়ে কোথাও যাবেন না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কাল জলমহলের মাছ ধরার কথা মনে আছে?
জি, আছে?
আজিজ গুণ্ডাবাহিনী পাঠাবে মাছ লুট করার জন্য, সে ব্যাপারে কি করবেন?
মনে হয় তিনি গুণ্ডাবাহিনী পাঠাবেন না।
আপনার মনে কি হয় না হয় তা জানতে চাই নি, কি প্রস্তুতি নিয়েছেন জানতে চেয়েছি।
প্রতিবারে জলমহলে মাছ ধরার সময় দাঙ্গায় উভয় পক্ষের অনেকেই হতাহত হয়। তাই আমি দাঙ্গা করতে চাই না। সে জন্য যা কিছু করার আমি করব। এ ব্যাপারে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব।
কিন্তু আপনি যদি কিছু করতে না পারেন, তা হলে কি বিরাট ক্ষতি আমাদের হবে ভেবেছেন?
জি, ভেবে চিন্তেই কথাটা বলেছি। বললাম না, ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব?
ফায়জুন্নেসা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, শুনুন, আপনি কি করবেন না করবেন, জানি না। আমি চাই, আমাদের বাহিনী তৈরি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, তাই হবে।
হাশেমের কাছে শুনেছি, আপনি নাকি একদিন আজিজদের গ্রামে গিয়েছিলেন সে সময় তার গুণ্ডাবাহিনী খুন করার জন্য আপনার উপর হামলা করেছিল, কথাটা কি সত্য?
জি সত্য।
ওদের হাত থেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে এলেন কি করে?
আল্লাহ ফিরিয়ে এনেছেন।
ফায়জুন্নেসা চিন্তা করলেন, কালই ম্যানেজারের কথার সততা জানা যাবে। অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক আছে, এবার আপনি আসুন।
ফায়সাল বলল, ছুটি দিতে হবে।
কেন?
বাড়ি যাব।
কবে যাবেন?
পরশু।
কত দিনের ছুটি চান?
পনের দিনের।
ফায়সাল এর আগে এক সপ্তাহের বেশি ছুটি নিয়ে বাড়ি যায় নি। পনের দিনের কথা শুনে ফায়জুন্নেসা বললেন, এবারে এত বেশি দিন কেন?
প্রয়োজন আছে, যদি মনে করেন এত দিন ছুটি দেয়া যাবে না, তা হলে আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী দিন।
ঠিক আছে, পনের দিনই মঞ্জুর করলাম।
ধন্যবাদ, বলে ফায়সাল সালাম বিনিময় করে বেরিয়ে এল।
নির্দিষ্ট দিনে জলমহলে নির্বিঘ্নে মাছ ধরে বিক্রি করা হল। আজিজের গুণ্ডাবাহিনী মাছ লুট করতে আসে নি জেনে শুধু লুৎফা বেগম ও ফায়জুন্নেসা নয়, ফায়সালের উপর চৌধুরী বাড়ির সকলের ভক্তিশ্রদ্ধা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেল।
ঐ দিন এক সময় ফায়জুন্নেসা মৃণালবাবুকে ডেকে ম্যানেজারের কাজ-কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুব সন্তুষ্ট হলেন এবং এমন কিছু বিষয় জানতে পারলেন, যা শুনে ভীষণ অবাকও হলেন। হঠাৎ মনে পড়ল, ম্যানেজার বলেছিলেন, “স্বপ্না খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবে।” কই আজ আট দশদিন হয়ে গেল স্বপ্না তো এল না? তা হলে কি সে ফিরে এসে ঢাকাতেই আছে? মায়ের কাছে গিয়ে কথাটা বললেন।