তাও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমাদেরকে জানিয়ে যাবে না?
হাশেমকে জিজ্ঞেস করেছিস?
করেছি, সেও কিছু জানে না।
পরশু জলমহলে মাছ ধরা হবে, আজিজের গুণ্ডাবাহিনী নিশ্চয় মাছ লুট করতে আসবে। এদিকে ম্যানেজারের কোনো খোঁজ নেই। কি হবে না হবে চিন্তা করেছিস?
ভাবছি, কালকের মধ্যে ম্যানেজারের খোঁজ না পাওয়া গেলে মাছধরা বন্ধ থাকবে।
হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে। আগে ম্যানেজারকে খুঁজে বের করতে হবে। আচ্ছা, ও কোনো বিশেষ কারণে ঢাকা যায় নি তো?
তা কি করে হয়? যে কারণেই যান না কেন, বলে নিশ্চয় যেতেন।
লুৎফা বেগম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, ওর মতো ছেলের তাই তো করা উচিত, কিন্তু হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাবে ভাবতেই পারছি না।
ফায়জুন্নেসা বললেন, ভাবছি কাল ঢাকায় ওর বাড়িতে খোঁজ নিতে লোক পাঠাব।
সেটাই ঠিক হবে বলে লুৎফা বেগম মেয়ের কাছ থেকে চলে গেলেন।
পরের দিন ভোরে ফজরের নামায পড়ে লুৎফা বেগম কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। এমন সময় ওনার খাস চাকরানি ফরিদা হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, ম্যানেজার সাহেব এসেছেন।
শোকর আল হামদুলিল্লাহ বলে লুৎফা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তুই জানলি কি করে?
ফরিদা বলল, হাশেম মিয়া আপনাকে জানাবার জন্য বলল।
তুই গিয়ে হাশেমকে বল, ম্যানেজারকে উপরের বসার ঘরে নিয়ে আসতে।
হাশেম ম্যানেজারকে লুৎফা বেগমের কথা বলে উপরের বসার ঘরে এনে বসতে বলে চলে গেল।
একটু পরে লুৎফা বেগম এলেন।
ফায়সাল সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
লুৎফা বেগম বললেন, তুমি আর ভালো থাকতে দিলে কই? তা কাউকে কিছু বলে হঠাৎ কোথায় গিয়েছিলে? এদিকে আমরা তোমার চিন্তায় অস্থির। ফায়জুন্নেসা লোজন দিয়ে কত খোঁজ করাল। আজ যদি না আসতে, কাল ঢাকায় তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠাত।
স্টেটের একটা বিশেষ কাজের জন্য হঠাৎ আমাকে এক জায়গায় যেতে হয়েছিল। জানিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানাই নি। সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
কি এমন বিশেষ কাজে গিয়েছিলে?
পরে বলব, এখন বলতে পারছি না বলে আবার ক্ষমা চাইছি।
তুমি তো ফায়জুন্নেসাকে চেনো, আমি ক্ষমা করলেও সে কি করবে?
আল্লাহ আমাকে ক্ষমা আদায় করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
তুমি কি খুব ক্লান্ত?
কেন বলুন তো?
কিছুক্ষণ আলাপ করতে চাই।
না, আমি ক্লান্ত নই। কি আলাপ করতে চান করুন।
তুমি কি চৌধুরী বংশের পূর্ব ইতিহাস জান?
জি, জানি।
কি জান বলতো।
ফায়সাল সবকিছু বলার পর লুৎফা বেগম অবাক কণ্ঠে বললেন, এসব জানলে কি করে?
মাফ করবেন বলতে পারব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, আল্লাহর মেহেরবাণীতে আমি চেষ্টা করে জেনেছি।
জিন ও সোনার মহরের কথা বিশ্বাস কর?
জি, করি।
জিনেরা চৌধুরী বংশের পরপর তিন পুরুষ ও জামাই হারেসকে মেরে তাদেরকে একই জলমহলে ফেলে রেখেছিল, বিশ্বাস কর?
জি, করি।
তোমার কি ধারণা, জিনেরা চৌধুরী বংশের সন্তান হিসাবে প্রথমে ফায়জুন্নেসাকে ও পরে তার মেয়ে জেবুন্নেসাকেও মেরে ঐ একই জলমহলে লাশ ফেলে রাখবে?
জি, আমারও তাই-ই ধারণা। তবে জিনেরা এখন আর তা করবে না।
লুৎফা বেগম খুব অবাক হয়ে ফায়সালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তা করবে না বলতে পার?
পারি, তবে আপনাকে ওয়াদা করতে হবে সোনার পর আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না আর কাউকে এসব কথা বলবেন না।
লুৎফা বেগম আরো কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বেশ ওয়াদা করলাম।
ফায়সাল বলল, চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ জয়নুদ্দিন সোনার মোহর ভর্তি ঘড়া নিয়ে এখানে চলে আসার পর জিনেরা ওনাকে স্বপ্নে কিছু কাজ করতে বলেছিল। সেসব কাজ করলে ঘড়ার অর্ধেক সোনার মোহর খরচ হয়ে যাবে। তাই তিনি তা করেন নি। তাই জিনেরা ওনাকে মেরে জলমহলে ফেলে রাখে। তারপর ওনার বংশধর আবসার উদ্দিন ও ইনসান চৌধুরীকেও স্বপ্নে জিনেরা সেই কাজ করতে বলে। কিন্তু ওনারাও খরচের ভয়ে করেন নি। তাই ওনাদেরকেও জিনেরা, মেরে একই জলমহলে ফেলে রাখে। তারপর ফায়জুন্নেসাকেও জিনেরা একই স্বপ্না দেখায়। তিনিও স্বপ্নাকে স্বপ্না মনে করে তা করেন নি বরং পাপের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। জিনেরা ওনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল; কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোনো কিছুই হয় না। তাই জিনেরা ওনাকে মেরে ফেলার আগে আল্লাহ তার এক নেক বান্দাকে দিয়ে জিনেদের বাধা দেন এবং সেই নেক বান্দা জিনেদের কাছে ওয়াদা করে ফায়জুন্নেসার তিন পূর্বপুরুষ যা করেন নি তিনি তা ফায়জুন্নেসাকে দিয়ে করাবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ফায়জুন্নেসা এখনও বেঁচে আছেন। নচেৎ কবেই ঐ জলমহলে ওনার লাশ পাওয়া যেত। _ ফায়সালের কথা শুনে লুৎফা বেগম বুঝতে পারলেন এই ম্যানেজারই আল্লাহর সেই নেক বান্দা। একে দিয়েই আল্লাহ চৌধুরী বংশের উপর থেকে জিনেদের দুশমনির অবসান করিয়েছেন। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার সময় চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তার আসল পরিচয় জানার জন্য ওনার মন ব্যাকুল হয়ে উঠলেও ওয়াদার কথা চিন্তা করে কিছু বলতে পারলেন
ফায়সাল লুৎফা বেগমের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, আপনি আল্লাহর ঈমানদার বান্দি, তাই স্বামীর ও মেয়েদের কোনো অন্যায় মেনে নিতে না পেরে অনেক প্রতিবাদ করেছেন। ফলে স্বামীর অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন। মেয়েও আপনাকে অনেক অপমান করেছেন। আপনি সেসব সহ্য করে তাদেরকে হেদায়েত করার জন্য সব সময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। আল্লাহ তার ইমানদার বান্দা-বান্দিকে নিরাশ করেন না। তবে কখন সেই দোয়ার প্রতিফল বান্দার জন্য মঙ্গল হবে সে খবর তিনিই জানেন এবং সেই সময় দিয়েও থাকেন। এখন যা কিছু জানলেন, তা আপনার নেক দোয়ার প্রতিফল। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করেন ও ঈমানদারীর সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করার তওফিক দেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু দেন।