এতক্ষণ মুসাফিরের কথা শুনে খুশি হলেও শেষের কথা শুনে আজিজের মনে যেমন সন্দেহ হল, তেমনি রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গে বললেন, কে আপনি? চৌধুরী বংশের সঙ্গে আমাদের বিরোধের কথা জানলেন কি করে?
মুসাফির মৃদু হেসে বললেন, রাগ করছেন কেন? আমি আল্লার এক নাদান বান্দা। পথভ্রষ্ট মানুষকে পথে ফিরিয়ে আনা আমার কাজ। শুনুন, শুধু চৌধুরী বংশের বিরোধের কথা নয়, বিরোধের উৎপত্তি ও তার পরের সমস্ত ঘটনা, এমন কি ইনসান চৌধুরীর মেয়ে কেন স্বামীর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং ওনার স্বামীর মৃত্যু রহস্যও আমি জানি। আরও জানি আপনি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও এত সয়-সম্পদের মালিক হলেন কি করে? আরো জানি, চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষের আদিবাস ছিল ডোমারে। জিনেদের একঘড়া সোনার মোহর পেয়ে খোকসাবাড়ি এসে বসবাস শুরু করেন। সেই জিনেরা চৌধুরী বংশের পরপর তিন পুরুষকে মেরে একই জলমহলে ফেলে রেখেছিল। আমার কথা শুনে যদি মনে করেন, আমি চৌধুরী বংশের লোক অথবা তাদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছি, তা হলে ভুল করবেন। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনার তো গুণ্ডা বাহিনী আছে, তাদের দিয়ে এই বুড়োকে মেরে সেই জলমহলে ফেলে দেবেন। তা হলে সবাই মনে করবে, জিনেরা মুসাফিরকেও মেরে ফেলে রেখেছে। পুলিশ কেসও আর হবে না। মুসাফিরের কথা শুনে রাগ পড়ে গিয়ে আজিজের মনে ভয় ঢুকে গেল। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
মুসাফির ওনার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, আর দেরি করতে পারছি, এবার আসি বলে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, যাওয়ার সময় একটা কথা বলে যাই, বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। কয়েকদিনের মধ্যে চৌধুরীরা যে জলমহলে মাছ ধরবে, সেখানে আপনার গুণ্ডা বাহিনী পাঠাবেন না। পাঠালে গুণ্ডারা কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারবে কি না সন্দেহ। আর একটা কথা, যদি আমার প্রতি আপনার সামন্যতম বিশ্বাস থাকে, তা হলে অতি সত্বর চৌধুরীদের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। উনি মানুষ হলেও ওনার চরিত্র ফেরেস্তার মতো। শুনেছেন কিনা জানি না, উনি ম্যানেজার হয়ে আসার পর চৌধুরী বাড়ির আবহাওয়া পাল্টে গেছে। উনি বাড়ির চাকর-চাকরানি থেকে সবাইকেই দ্বীনের পথে এনেছেন। ইনসান চৌধুরীর ডাকসাইটের মেয়ে ফায়জুন্নেসা পর্যন্ত ম্যানেজারের কাছে নত হয়েছেন। উনিও চান আপনাদের সঙ্গে চৌধুরী বংশের মিটমাট হয়ে যাক। আর একটা কথা, মিটমাট হয়ে যাওয়ার পর এ বছরই হজ্ব করে আসুন। আর যা কিছু গর্হিত কাজ করেছেন, সেজন্যে তওবা করে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে মাফ চাইবেন। কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন।
আজিজের মনে তখন ভয়ের ঝড় বইছে। ওনার মনে হল, মুসাফির মানুষ নয়, অন্য কিছু। তা না হলে তার ও চৌধুরী বংশের সবকিছু জানলেন কি করে? এই সব চিন্তা করে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন।
আজিজের স্ত্রী জাহেদা স্বামীর সব ক্রিয়াকলাপ জানেন। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন কিন্তু আজিজ রেগে গিয়ে ভীষণ মারধর করতেন। তাই জাহেদা পরে আর প্রতিবাদ করেন নি। আজ বৈঠকখানার বাইরে থেকে মুসাফিরের কথা শুনে তিনিও খুব ভয় পেয়েছেন। মুসাফির চলে যাওয়ার পর ভিতরে এসে স্বামীর ভয়ার্ত মুখ ও তাকে কাঁপতে দেখে সাহস দেয়ার জন্য বললেন, মনে হয়, মুসাফির মানুষ নয়, চৌধুরী বংশের উপর যে জিনের আক্রোশ সেই জিন। উনি আমাদের ভালো চান, তাই এইসব কথা বলে সাবধান করে গেলেন।
জাহেদার সাথে ছেলে মহসীন ও বৌ আমেনাও এসেছে। খোকসাবাড়ির চৌধুরীদের সঙ্গে শত্রুতার কথা মহসীন জানে। কিন্তু শক্রতার কারণ জানে না। একদিন বাবাকে সে কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আজিজ বলেছিলেন, ওসব তোর জানার দরকার নেই। আজ মুসাফিরের কথা শুনে শত্রুতার কারণ অল্প কিছু আন্দাজ করতে পারল। তার মনে হল, চৌধুরীরা তাদের সঙ্গে শত্রুতা করে না, বরং বাবাই তাদের সঙ্গে শত্রুতা করে আসছে। মা থেমে যেতে বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে বাবা। মুসাফির যা কিছু করতে বলে গেলেন, তাই করলে হত না?
আজিজ ছেলে বৌকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা এখান থেকে যাও। তারা চলে যাওয়ার পর স্ত্রীকে বললেন, আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে চল, খুব দুর্বল লাগছে, দাঁড়াতে পারছি না। -.
যে রাতে ফায়জুন্নেসা ও লুফা বেগমের সাথে ফায়সালের আলাপ হয়, তার পরের দিন সকাল থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। চৌধুরী বাড়ির চাকর-চাকরানি থেকে ফায়জুন্নেসা ও ত্যা বেগম পর্যন্ত খুবই উদ্বিগ্ন। ফায়জুন্নেসা গুণ্ডাবাহিনীকে ফায়সালের খোঁজ করতে বললেন। তারা আশপাশের কয়েকটা গ্রামে খোঁজ করেও পেল না। দু’তিন দিন খোঁজ না পেয়ে ফায়জুন্নেসা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবলেন, তা হলে কি আজিজের গুণ্ডারা তাকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলেছে।
লুৎফা বেগম মেয়েকে বললেন, অত ভালো ছেলে আমি জীবনে দেখি নি।
ফায়জুন্নেসা বললেন, আমিও দেখি নি।
আমার কি মনে হয় জানিস, আজিজের গুণ্ডারা তাকে খুন করেছে।
আমারও তাই মনে হচ্ছে, তবে বিশ্বাস করতে পারছি না। ম্যানেজার মারামারিতে সব বিষয়ে পারদর্শী, নিজেকে রক্ষা করার কলা কৌশলেও পারদর্শী। আজিজের গুণ্ডারা তার সঙ্গে পেরে উঠবে বলে মনে হয় না। নিশ্চয় বিশেষ কোনো কাজে কোথাও গেছেন।