যাই হোক, মুসলমানদের অবক্ষয়ের কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আপনারা অনেকে না খেয়ে নামায পড়তে এসেছেন। আপনাদের আর কষ্ট দেব না। শেষে আর একটা কথা বলে ইতি টানব, আমাদের মন থেকে হিংসা বিদ্বেষ, দলাদলি ও লোভ-লালসা দূর করে একে অন্যের বিপদে সাহায্য করতে হবে। ইসলামের জ্ঞান অর্জনের জন্য মাদরাসা ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মাতব্বরদের ন্যায় বিচার করতে হবে। যদিও অপরাধী বাপ, ভাই বা ছেলে হোক না কেন। মনে রাখবেন প্রতিটি কাজের জন্য, সবাইকে হাশরের মাঠে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই প্রতিটি মুমীন মুসলমানকে মউত, কবর, হাশর ও জাহান্নামের কথা চিন্তা করে দুনিয়াদারী করতে হবে। এসব কাজে মসজিদের ইমাম সাহেবদেরকে অগ্রভূমিকা নিতে হবে। যদি ওনারা মনে করেন, বেতন নিয়ে শুধু নামায পড়াবেন আর মিলাদ পড়িয়ে ইনকাম করে সুখে দিন কাটাবেন, স্বাধীনভাবে দ্বীনের হক কথা বললে মসজিদ কমিটি ছাঁটাই করে অন্য ইমাম রাখবেন, তা হলে বিরাট ভুল করবেন। কারণ এরকম মনে করলে আপনি আল্লাহর গোলাম না হয়ে মসজিদ কমিটির গোলাম হয়ে গেলেন।
প্রায় দেখা যায় প্রতিটি মসজিদের কমিটির সদস্যগণের দ্বীনি এলেম নেই। তাই ওনারা কমজোর ঈমানওয়ালা ইমাম সাহেবদেরকে গোলাম বানিয়ে রেখেছেন। ঐসব ইমাম সাহেবরা স্বাধীনভাবে দ্বীনের কথা বলতে পারেন না চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে। সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হল, তারা আল্লাহর গোলামী না করে দুনিয়াদারী হাসিলের জন্য শয়তানের গোলামী করছে। মনে রাখবেন, যারা আল্লাহর গোলামী পরিত্যাগ করে শয়তানের গোলামী করবে, কিছু দিনের জন্য তারা সুখ ভোগ করলেও অচিরে তাদের উপর দুনিয়াতে যেমন আল্লাহ নানারকম বিপদ আপদ ও গযব নাজিল করবেন, তেমনি আখেরাতেও তাদেরকে জাহান্নামে দাখেল করবেন। সবশেষে মুরুব্বীদের ও যারা ছেলেমেয়ের বাবা, তাদের কাছে একান্ত অনুরোধ, আপনারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে সেইমতো নিজেকে ও পরিবারের সবাইকে চালিত করার চেষ্টা করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনকে বোঝার ও সেই মতো চলার তওফিক দান করুন, আমিন। এবার আপনারা আসুন।
মুসাফিরের ওয়াজ আজিজের মনে রেখাপাত করল। সবাই চলে যাওয়ার পর বললেন, আজ রাতে আমার বাড়িতে খাবেন আর যে কয়েকদিন এখানে থাকবেন, আমার বাড়িতেই থাকবেন। আপনার কাছ থেকে আরো মূল্যবান কথা শুনব।
মুসাফির বললেন, মাফ করবেন, আমি কারো বাড়িতে খাই না। অপারগ অবস্থায় খেলেও টাকা দিয়ে খাই। আপনি এই গ্রামের মানি, গুণী ও গণ্যমান্য লোক। খাওয়ার জন্য টাকা দিলে আপনাকে অপমান করা হবে। কাল ফজরের নামায পড়ে এখান থেকে চলে যাব। তাই আজ এশার নামাযের পর আপনার বাড়িতে যাব। কিন্তু একথা কাউকে জানাবেন না। তবে আপনার পরিবারের সবাইকে জানাতে পারেন। ওনারা যেন রুমের বাইরে থেকে আমার কথা শুনতে পান, সে ব্যবস্থা করবেন। আবার বলছি, আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন না। আমি খাওয়া-দাওয়া করেই যাব।
আজিজ বললেন, খাওয়া-দাওয়া না করলেও আপনি যাবেন শুনে খুব খুশি হয়েছি। তারপর মোসাফাহা ও সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।
মুসাফির যখন আজিজের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল তখন রাত প্রায় দশটা। আজিজ বৈঠকখানায় ওনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দরজার কাছে এসে সালাম দিতে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে সালামের উত্তর দিলেন। তারপর সাদরে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে এসে বসালেন। আজিজ ঘরের সবাইকে বলে দিয়েছিলেন, মুসাফির আসার পর তোমরা বৈঠকখানার দরজা জানালার কাছে থেকে ওনার কথা শুনবে। ওনার আসার খবর পেয়ে সবাই বৈঠকখানার বাইরে এসে জমা হল।
মুসাফির বললেন, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। কয়েকটা কথা বলছি শুনুন, মানুষ সাধারণত ধন-সম্পদ, মান-সম্মান ও সুখ শান্তি কামনা করে। কিন্তু সবাই কি তা পায়? পায় না। ততটুকু পায়, যতটুকু আল্লাহ তার তকদিরে লিখে রেখেছেন। তাই যার যতটুকু আছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। হাদিসে আছে, “অল্পে সন্তুষ্টি বৃহৎ সম্পত্তির মালিক।” তাই বলে বড় হবার চেষ্টা করবে না, তা নয়। তবে সেই চেষ্টা সৎ পথে হতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা বড় হতে চায়, তারা সৎ-অসৎ বিচার না করে অবৈধ পথে উপার্জন করছে। অথচ অবৈধ পথে উপার্জন করা হারাম। আপনার বিষয়-সম্পদ অনেক, এসব যদি সৎ পথের উপার্জনে হয়, তা হলে খুবই ভালো, আর যদি অসৎ পথে হয়ে থাকে, তা হলে খুবই খারাপ। বেশিরভাগ মানুষ শয়তানের প্রলোভনে পড়ে যেমন অন্যায় পথে রুজী-রোজগার করে, তেমনি এমন অনেক গর্হিত কাজও করে, যেগুলো আল্লাহ হারাম করেছেন। আর যারা হারাম পথে রুজী-রোজগার করেন তাদের কোনো ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। তাই সবাইয়ের উচিত সব রকমের অন্যায় পরিত্যাগ করে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর ও তাঁর রসুল (দঃ) এর বিধান মেনে চলা। মনে রাখবেন, শুধু ধন-সম্পদের মালিক হলেই মান-সম্মান ও সুখ-শান্তি পাওয়া যায় না। সবকিছু পাওয়া না পাওয়া আল্লাহপাকের ইচ্ছ। তিনি ইচ্ছা করলে মুহূর্তে ধনীকে গরিব ও গরিবকে ধনী করে দিতে পারেন। আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা প্রচুর রেযে দান করেন এবং (যাহাকে ইচ্ছা) সংকীর্ণ করিয়া দেন; আর ইহারা পার্থিব জীবনের উপার্জন করে, অথচ এই পার্থিব জীনব আখেরাতের তুলনায় অতি তুচ্ছ সামগ্রী ত্নি কিছুই নহে।”[৮] যাই হোক, এবার আপনাকে অনুরোধ করব, খোকসাবাড়ির চৌধুরীদের সঙ্গে আপনাদের যে বিরোধ অনেক দিন থেকে চলে আসছে, তা মিটিয়ে ফেলুন। নচেৎ আপনি বেঁচে থাকতে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, মারা যাওয়ার পর আপনার বংশধররা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু তাই নয়, আখেরাতে কি হবে তা আল্লাহ ভালো জানেন।