জি, জানি। মরহুম ইনসান চৌধুরীর বেগম আপনি। ইচ্ছা করলে আমাকে কঠিন শাস্তি দিতে পারেন। আর এটাও জানি, আমার উপর যতই রেগে যান না কেন, এই মুহূর্তে কঠিন শাস্তি কেন, লঘু শাস্তিও দেবেন না।
কি করে বুঝলে?
আপনি বিচক্ষণ মহিলা, আপনার ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও প্রখর। রাগের অভিনয় করে আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার না বলা কথাগুলো জানতে চাচ্ছেন।
ম্যানেজারের কথা এনে অংফা বেগম এত অবাক হলেন যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। কারণ তিনি তাই-ই চেয়েছিলেন। সামলে নিয়ে বললেন, সত্যি করে বলতো তুমি মানুষ না অন্য কিছু।
নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন না বলে ফায়সাল লুৎফা বেগমের পায়ে হাত রেখে বলল, আমি যে মানুষ এবার বিশ্বাস হল তো?
ঠিক আছে, উঠে বস।
ফায়সাল বসল না, দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এবার যাওয়ার অনুমতি দিন।
আর একটু বস, দু’একটা কথা বলব।
ফায়সাল বসার পর বললেন, জেনেছি তুমি এ বাড়ির সবাইকে কুরআন হাদিসের বাণী শুনিয়ে ধর্মের পথে এনেছ; কিন্তু তোমার মালেকিনের জন্য কিছু কর নি কেন? না তাকে খুব ভয় পাও?
মুমিনরা আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। মালেকিনের ব্যাপারে একেবারেই যে কিছু করি নি তা নয়। যতটুকু করেছি তার ফলাফল কিছু দিনের মধ্যে দেখতে পাবেন।
শুনে খুশি হলাম বলে লুৎফা বেগম বললেন, এবার তুমি এস।
.
আজ তিন দিন আজিজের গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের বাড়িতে সাদা চুল দাড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধ মুসাফির রয়েছেন। উনি দিন রাতের মধ্যে বেশিরভাগ সময় মসজিদে ইবাদত বন্দেগী করেন। দিনে রোযা থাকেন। ইমাম সাহেব মসজিদেই ইফতার পাঠান। এশার নামাযের পর ইমাম সাহেবের সঙ্গে ওনার বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে আবার মসজিদে চলে আসেন। ইমাম সাহেব এই গ্রামেরই লোক। বয়স প্রায় সত্তরের কাছা-কাছি। উনি কুরআনের হাফেজ ও পরহেজগার। ইমামতি করে কোনো টাকা পয়সা নেন না।
ইমাম সাহেব একদিন জোহরের নামাযের পর একজন সুফি ধরনের বৃদ্ধ লোককে মসজিদে বসে তসবিহ পড়তে দেখে সালাম বিনিময় করে পরিচয় জানতে চাইলেন। তখনও যে সব মুসুল্লি মসজিদে ছিল, তারা ইমাম সাহেবকে একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে আলাপ করতে দেখে কাছে এস বসল।
লোকটি বললেন, আমি মুসাফির মানুষ। আমার নিজস্ব কোনো বাড়ি ঘর নেই। দেশ ভ্রমণ করা ও আল্লাহর ইবাদত করাই আমার একমাত্র কাজ।
মুসাফিরকে ইমাম সাহেবের খুব ভালো লাগল, বললেন, আমার সঙ্গে বাড়িতে চলুন, খাওয়া-দাওয়া করবেন।
মুসাফির ইমাম সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চস্বরে বললেন, রোযা আছি।
কথাটা শুনে ওনার উপর ইমাম সাহেবের ভক্তি বেড়ে গেল। উনিও মুসাফিরের কানে কানে বললেন, তা হলে আমার বাড়িতে ইফতার করবেন, রাতে খানাও খাবেন।
একইভাবে মুসাফির বললেন, আমি কারো বাড়িতে খাই না। তবে আপনাকে পরহেজগার মনে হচ্ছে, তাই আপনার বাড়িতে খাব। কিন্তু যে কয়েকদিন এখানে থাকব, বাজার অনুপাতে আপনাকে টাকা নিতে হবে।
ইমাম সাহেও একইভাবে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ) মুসাফিরের খিদমত করতে বলেছেন। আমি তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য আপনার সব রকমের খিদমত করতে চাই। আর আপনি তা থেকে বঞ্চিত করার জন্য বখিলের পরিচয় দিচ্ছেন।
মুসাফির আর কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
ইমাম সাহেব লোকজনদের নিয়ে মসজিদের বাইরে এসে বললেন, তোমরা ওনার সঙ্গে বেয়াদবের মতো কথাবার্তা বলো না। উনি সুফি মানুষ, দেশ ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন।
একজন মুসুল্পি জিজ্ঞেস করল, আপনারা কানে কানে কি কথা বললেন?
দু’জনের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে, ইমাম সাহেব সেসব বলে বললেন, উনি যে অলি-আল্লাহ ধরনের লোক, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?
মুসুল্লিরা তা স্বীকার করে যে যার পথে চলে গেল। দু’তিন দিনের মধ্যে মুসাফিরের কথা গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ল।
আজিজের বাড়ি থেকে মসজিদ বেশ খানিকটা দূরে। তাই কিছু দিন থেকে নামায পড়তে শুরু করলেও মসজিদে না গিয়ে ঘরে পড়েন। তবে জুম্মা পড়তে মসজিদে যান। এক কান দু’কান করে ওনারও কানে কথাটা পড়েছে। ভেবেছেন, জুম্মা পড়তে গিয়ে মুসাফিরের সঙ্গে আলাপ করবেন এবং রাতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেবেন।
আজ জুম্মাবার। অন্যান্য দিনের চেয়ে নিয়মিত মুসুল্লি ছাড়াও অনেকে এসেছে মুসাফিরকে এক নজর দেখার জন্য। আজিজ ও তার ছেলেও এসেছেন।
প্রতি জুম্মাবারে আযানের পর ইমাম সাহেব কিছুক্ষণ ওয়াজ করেন। আজ ওয়াজ করার শেষে বললেন, মুসাফির হয়তো দু’একদিনের মধ্যে চলে যাবেন। তাই নামাযের পর আপনাদেরকে কিছু বলবেন। সবাই থাকবেন।
নামাযের পর মুসাফির দাঁড়িয়ে প্রথমে সালাম দিলেন। তারপর আল্লাহর প্রশংসা ও রসুল (দঃ)-এর উপর কয়েক মর্তবা দরুদ পাঠ করে বললেন, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা। আল্লাহ মেহেরবাণী করে আমাকে কিছু এলেম হাসিল করিয়েছেন। আল্লাহ কালামপাকে কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত যেমন ফরজ করেছেন, তেমনি যারা দ্বীনি এলেম হাসিল করেছেন তাদের উপরও ফরয করেছেন, সেই দ্বীনি এলেম মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার। সেই ফরয আদায়ের জন্য আমি যেখানেই যাই সেখানেই মানুষকে ধর্মের কথা জানিয়ে অসৎ কাজ করতে নিষেধ করি ও সৎ কাজ করার কথা বলি।