মনে হচ্ছে আমার কথায় অপমান বোধ করে খুব রেগে গেছেন। আমি কিন্তু আপনাকে অসন্তুষ্ট করার জন্য কথাটা বলি নি, বলেছি স্টেটের ভালোর জন্য। প্রত্যেকের জীবনে কিছু না কিছু গোপনীয়তা থাকে। স্বেচ্ছায় না বললে জোর খাটিয়ে জানতে চাওয়া কারো উচিত নয়। আপনি জানেন কি না জানি না, আপনার মেয়ে স্বপ্নার রেজাল্ট বেরিয়েছে, উনি খুব শিঘ্রি ফিরে আসছেন। এখন আপনি নিশ্চয় জানতে চাইবেন, এ কথা আমি জানলাম কি করে? এর উত্তরও আমি দিতে পারব না। এজন্য আমার উপর আপনার অসন্তুষ্ট হওয়া কিংবা জোর করে জানতে চাওয়া উচিত হবে না।
স্বপ্না তিন মাস আগে মাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, তার ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ, রেজাল্ট বেরোবার পর আসবে। চিঠি পড়ে ফায়জুন্নেসা মা লুৎফা বেগমকে কথাটা জানিয়েছিলেন। ওনারা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না, জানা সম্ভবও নয়। এখন ম্যানেজারের মুখে পা খুব শিল্লি ফিরে আসছে শুনে এত অবাক হলেন যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না।
ফায়সাল মৃদু হেসে বলল, আমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করে জানতে পারলাম দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না। ও হ্যাঁ, কিছুদিন থেকে একটা কথা আপনাকে বলব ভাবছি। আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মধ্যে মাদরাসা নেই। যার ফলে ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে পড়লেও ধর্মের জ্ঞান কিছুই পাচ্ছে না। তাই এই গ্রামে একটা মাদরাসা করতে চাই। আপনার অনুমতি পেলে আমি সে ব্যাপারে অগ্রসর হব।
ফায়জুন্নেসার তখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, স্বপ্না বাড়ি আসার কথা ম্যানেজার জানলেন কি করে? তা হলে উনি কি সত্যিই আল্লাহর খাস বান্দা? দাদির মুখে শুনেছেন, যারা আল্লাহর খাস বান্দা, তাদেরকে আল্লাহ আগে ভাগে অনেক কিছু জানিয়ে দেন। যদি তাই হয়, তা হলে ম্যানেজার কি আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেন? গভীরভাবে এইসব চিন্তা করছিলেন বলে ফায়সালের মাদরাসা করার কথা শুনতে পেলেন না।
ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফায়সাল বলল, আমার কথার উত্তর দেবেন না?
লুৎফা বেগম ফরিদার মুখে দোতলার ড্রইংরুমে ম্যানেজারের সঙ্গে ফায়জুন্নেসা আলাপ করছে শুনে তাকে দেখার জন্য এসে এতক্ষণ পর্দার আড়াল (থকে তাদের আলাপ শুনছিলেন আর মাঝে মাঝে পর্দা ফাঁক করে ম্যানেজারকে দেখছিলেন। উনি দোতলার বারান্দা থেকে বাড়ির সামনের ক্ষেতে লোকজনদের দদারকী করতে তাকে কয়েকবার দেখেছেন। কাছ থেকে দেখে ওনার অন্তর জুড়িয়ে গেছে। এত সুন্দর ছেলে এর আগে কখনও দেখেন নি। তার কথা বার্তা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। স্বপ্নার খুব শিঘ্রি ফেরার কথা শুনে তিনিও খুব অবাক হয়েছেন। শেষে মাদরাসার কথা শুনে খুব খুশি হলেন। মেয়ে কিছু বলছে না দেখে ভিতরে ঢুকে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ম্যানেজারের কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
মায়ের কথায় ফায়জুন্নেসা সম্বিত ফিরে পেয়ে ফায়সালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি জিজ্ঞেস করেছেন?
ফায়সাল মাদরাসা করার ব্যাপারে যা বলেছিল, আবার বলল।
ফায়জুন্নেসা বললেন, এ ব্যাপারে পরে আলাপ করব। তারপর মাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলবে?
লুৎফা বেগম বললেন, হ্যাঁ।
তা হলে আমি এখন যাই বলে ফায়জুন্নেসা চলে গেলেন।
ওনাদের কথা বার্তায় ফায়সাল যদিও বুঝতে পারল, ইনি ফায়জুন্নেসার মা, তবু বলল, আপনার পরিচয় জানতে পারলে খুশি হতাম।
আমি লুৎফা বেগম, ফায়জুন্নেসার মা।
ফায়সাল প্রথমে দাঁড়িয়ে সালাম দিল, তারপর এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বলল, বসুন।
লুৎফা বেগম বসার পর ফায়সাল বসে বলল, আপনাকে দেখার ও আপনার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা অনেক দিনের। আজ আল্লাহ সেই ইচ্ছা পূরণ করে ধন্য করলেন, সেজন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করছি।
তার আচরণে লুৎফা বেগম আরো মুগ্ধ হলেন। বললেন, আপনার কথা চাকর-চাকরানিদের কাছে শুনে আমারও আপনাকে দেখার অনেক দিনের ইচ্ছা। ফায়জুন্নেসার সঙ্গে আপনার আলাপ দরজার বাইরে থেকে শুনেছি। তারপর ভিতরে ঢুকে আপনার আচরণ দেখে শুনে মনে হচ্ছে, এখানে চাকরি করতে যে বায়ডাটা দিয়েছেন, তা সত্য নয়। আসল পরিচয় বললে আমিও আপনার মতো খুশি হতাম।
ফায়সাল বুঝতে পারল, ইনি শুধু উচ্চশিক্ষিতা নন, বুদ্ধিমতীও। বলল, আপনাকে আমি খুশি করার চেষ্টা করব। তার আগে আমার একান্ত অনুরোধ আমাকে আপনি করে বলবেন না, তুমি করে বলবেন। আফটার অল আমি তো আপনার নাতির বয়সী।
ঠিক আছে, তাই বলব। এবার তোমার আসল পরিচয়টা বল।
আসল পরিচয় এখন কিছুতেই বলা সম্ভব নয়, সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে আল্লাহ রাজি থাকলে কিছুদিনের মধ্যে সবাই জানতে পারবেন।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে। এখানে চাকরি করতে আসা তোমার আসল উদ্দেশ্য নয়। আসল উদ্দেশ্যটা কি বলতে চাই?
দুঃখিত তাও বলা সম্ভব নয়। সে জন্য আবার ক্ষমা চাইছি।
আমার অনুমান সত্য না মিথ্যে, এতটুকু অন্তত বল।
সত্য।
লুফা বেগমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, শুনেছি, তুমি নাকি অনেক কিছু জান, চৌধুরী বংশের পূর্ব ইতিহাসও জান?
দয়া করে আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না, কারণ আমার পক্ষে উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।
লুৎফা বেগম রেগে উঠে বললেন, তোমার সাহস তো কম না, কার কথা অগ্রাহ্য করছ জান?