আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
কী মনে হচ্ছে তা হলে বল।
সায়মার প্রায় মনে হয়, গুলি খাওয়া ছেলেটাই আব্দুস সাত্তার সাহেব। কথাটা আপু বিশ্বাস করবে না ভেবে বলবে কিনা চিন্তা করতে লাগল।
কী রে, চুপ করে আছিস কেন? বলবি তো তোর কী মনে হয়?
শুনে তো বলবি, “তোর বুদ্ধি একদম কাঁচা।”
ঠিক আছে, আর কোনো দিন বলব না। এবার বল।
গুলি খাওয়া ছেলেটাই আব্দুস সাত্তার সাহেব।
রূপা চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, হঠাৎ তোর এরকম মনে হল কেন?
হঠাৎ মনে হয় নি, ঐ দিনই হয়েছে। তুই বিশ্বাস করবি না বলে বলি নি।
ঐ দিনই বা তোর মনে হল কেন?
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আব্দুস সাত্তার সাহেবের কথা তোর মনে না থাকলেও আমার ছিল। তাই যতক্ষণ ওখানে ছিলাম কাছের ও দূরের সব লাইট পোষ্টের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলাম। কাউকেই নামায পড়তে দেখি নি।
সায়মার কথা শুনে গুলি খাওয়া ছেলেটার সুন্দর বলিষ্ঠ শরীর, তার সৎ সাহস। ও ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার পর চোখে চোখ পড়ার কথা রূপার মনে পড়ল। সেই সাথে সারা তনুমনে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল। চিন্তা করল, সায়মার কথা সত্য। হলে সে খুব ভাগ্যবতী। তার মতো ছেলে জীবনে দেখে নি। চওড়া কপাল, খাড়া নাক, কপালজোড়া কালো মিশমিশে যুগল, মাথায় কোঁকড়ান চুল, প্রায় ছ’ফুট শম্বা হলেও স্বাস্থ্য খুব সুন্দর, সংযত ও ভদ্র আচরণ, কি দুরন্ত সাহস। পিস্তল দেখেও এতটুকু ভীত হয় নি। কী অসীম ধৈর্য? অভদ্র ছেলেটা অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করলেও এতটুকু উত্তেজিত হন নি। বরং সংযত কণ্ঠে হাসিমুখে কথা বলেছেন।
তাকে চুপ থাকতে দেখে সায়মা বলল, আমার কথা কতটা সত্য বিচার করছিস তাই না?
রূপা এতক্ষণ যেন সংসদ ভবনে ছিল। সায়মার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই চিন্তা করছিলাম।
তা ফলাফলটা ইতিবাচক, না নেতিবাচক?
রূপা মনের ভাব গোপন করে বলল, নেতিবাচক। কারণ তিনি যদি আব্দুস সাত্তার সাহেব হতেন, নিশ্চয় ঐদিন রাতে ফোন করতেন। আমার মনে হয়, কোনো বিশেষ কারণে ঐদিন আসতে পারেন নি।
আসতে না পারার কারণটা কেন উনি ঐদিন ফোন করে জানালেন না, সে কথার উত্তরে কী বলবি?
ফোন না করারও কারণ থাকতে পারে।
এতদিনেও কী কারণটা শেষ হয় নি? আমি তোর যুক্তি মানতে পারলাম না। ঘুম পাচ্ছে বলে সায়মা পাশ ফিরে শুল।
রূপাও ঘুমাবার চেষ্টা করল; কিন্তু ঘুমাতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই আব্দুস সাত্তারে কথা মনে পড়তে লাগল। ভাবল, ঐদিন উনি এলেন না কেন? এতদিন ফোনও করেন নি কেন? তারপর সংসদ ভবনের ঘটনাটা মনের পর্দায়। ভেসে উঠল। গুলি খাওয়া ছেলেটা এতদিনে সুস্থ হয়েছে কিনা কে জানে। এইসব ভাবতে ভাবতে একটু তন্ত্ৰামতো এসেছিল, ফোন বেজে উঠতে ছুটে গেল। ভাবল, নিশ্চয় আব্দুস সাত্তারের ফোন। তাড়াতাড়ি উঠে রিসিভার তুলে মনের আবেগে সালাম দিয়ে ফেলল।
সালামের উত্তর দিয়ে আব্দুস সাত্তার বলল, আগে বলুন ক্ষমা করেছেন।
তার আগে বলুন, ঐদিন সংসদ ভবন চত্বরে আসেন নি কেন? আর এতদিন ফোন করেন নি কেন? জানেন না, ওয়াদা ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ?
জানি। সেই জন্য সেদিন গিয়েছিলাম। আপনাদের সামনে গুলি হতে দেখেছি। গুলি খাওয়া ছেলেটাকে আপনারা নিয়ে চলে গেলেন তাও দেখেছি।
আপনি তো বলেছিলেন, কোনো একটা লাইট পোষ্টের কাছে নামায পড়বেন; কিন্তু তা তো পড়েন নি।
না পড়ি নি। ঘটনা দেখতে দেখতে পাঁচটা পঁচিশ বেজে গেল। তাই আপনারা চলে যাওয়ার পর পড়েছি।
তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু ঐদিন রাতে ফোন করেন নি কেন?
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিশেষ কারণে করতে পারি নি।
বিশেষ কারণটা এই পনের দিন পর্যন্ত বুঝি ছিল?
ঐদিন রাতে ফোন করলে পরের দিন রূপা তাকে দেখতে চাইতে পারে ভেবে আব্দুস সাত্তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করে নি। ভেবেছিল, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে করবে। আজ ডাক্তার ব্যান্ডিজ খুলে দিয়েছে। তাই ফোন করেছে। রূপার কথার উত্তরে। বলল, ঠিক কথাই বলেছেন।
রূপা রেগে উঠে বলল, বিশেষ কারণ না ছাই। আপনি আমাকে খেলাচ্ছেন। আমার তো মনে হচ্ছে, আপনি একটা ফ্রড।
আব্দুস সাত্তার মনে আঘাত পেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
কী হল? ফ্রড বলতে চুপ হয়ে গেলেন যে?
আব্দুস সাত্তার আহতস্বরে বলল, তাই যদি ভেবে থাকেন, তা হলে আপনাকে আর কোনো দিন বিরক্ত করব না। কথা শেষ করে লাইন কেটে দিল।
তার কথাগুলো রূপার কানে খুব করুণ শোনাল। কয়েক বার হ্যালো হ্যালো করে বুঝতে পারল, লাইন কেটে দিয়েছে। রিসিভার ক্যাডেলে রেখে চিন্তা করল, ফ্রড বলায় নিশ্চয় মনে কষ্ট পেয়ে লাইন কেটে দিয়েছেন। হঠাৎ মনে হল, তিনি হয়তো কাটেন নি, এমনি কেটে গেছে। যদি তাই হয়, তা হলে আবার ফোন। করবেন ভেবে অপেক্ষা করতে লাগল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন ফোন এল না তখন নিশ্চিত হল, লাইন কেটেই দিয়েছেন। ভাবল, সত্যিই কী তিনি আর। কোনো দিন ফোন করবেন না? কথাটা ভেবে মনের গহীনে কাঁটা বিধার মতো ব্যথা অনুভব করল। মনকে বোঝাল, কোথাকার কে, যাকে কোনো দিন দেখে নি, যে। নাকি পরিচয় দেয় নি, সামনে আসার যার সৎ সাহস নেই, তার জন্য ব্যথা পাওয়া। উচিত নয়।
ঘুম পাচ্ছে বলে সায়মা পাশ ফিরে শুলেও ঘুমায় নি। সেও গুলি খাওয়া ছেলেটার কথা চিন্তা করছিল। ফোন বেজে উঠতে কান খাড়া করে এতক্ষণ ঘুমের ভান করে পড়েছিল। হ্যালো হ্যালো করে রূপা রিসিভার রেখে দিতে বুঝতে পারল, লাইন কেটে গেছে। আবার ফোন আসার অপেক্ষায় তাকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে দেখে বলল, আজ হয়তো আর লাইন পাচ্ছেন না; কাল নিশ্চয় করবেন। এবার শুয়ে পড়।