রূপা ও সায়মার সঙ্গে একজন রক্তাক্ত ছেলেকে আসতে দেখে ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিল। আব্দুস সাত্তার দু’বোনকে উদ্দেশ্য। করে বলল, দেখুন, আমি একটা রিক্সা…
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে রূপা বলল, আপনার কোনো কথাই শুনব।, গাড়িতে উঠুন। এই অবস্থায় আপনি একা রিকসায় যেতে পারবেন না।
সরওয়ার্দি হাসপাতাল থেকে ড্রেসিং ও ব্যান্ডিজ করিয়ে বাইরে এসে রূপা বলল, চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই।
আব্দুস সাত্তার বলল, আমার জন্য আপনারা অনেক করেছেন। সে জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। আগের থেকে অনেক সুস্থ বোধ করছি, একা যেতে কোনো অসুবিধে হবে না। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে একা স্কুটারে উঠে চলে গেল।
দুই বোন হাঁ করে স্কুটারের দিকে তাকিয়ে রইল। অদৃশ্য হয়ে যেতে সায়মা বলল, আপু, ছেলেটা কিন্তু দারুণ।
রূপা বলল, দারুণ মানে?
মানে ছেলেটা যেমন দেখতে তেমনি সাহসী।
হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। চল বাসায় যাই।
সে কী? সংসদ ভবনে যাবে না? আব্দুস সাত্তার সাহেব হয়তো নামায পড়ে লাইট পোষ্টে হেলান দিয়ে তোর অপেক্ষায় তসবীহ পড়ছেন।
রূপা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তুই দিন দিন খুব ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। কেউ শুনে ফেললে কী মনে করত বলত?
সায়মা হেসে উঠে বলল, চারপাশে কেউ নেই দেখেই বলেছি। এখন কোথায় যাবি বল।
রূপা ঘড়ি দেখে বলল, সোয়া ছ’টা বাজে। এখন আর সংসদ ভবনে যেতে ইচ্ছা করছে না।
সায়মা হেসে উঠল।
কীরে হাসছিস যে?
হাসি পেল তাই হাসলাম।
শুধু শুধু কারো হাসি পায় না। কেন হাসি পেল বলবি তো?
সায়মা হাসি থামিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা পৌণে পাঁচটায় পৌঁছে পাঁচটা পঁচিশ পর্যন্ত ওখানে ছিলাম। আমার ধারণা, এর মধ্যে আব্দুস সাত্তার সাহেব। নিশ্চয় কোনো একটা লাইট পোষ্টের কাছে নামায পড়েছেন এবং পুরো ঘটনাটা ও ছেলেটাকে নিয়ে ওখান থেকে চলে আসতে দেখেছেন। আমার গলায় বাইনোকুলার। ঝুলতে দেখে হয়তো ভেবেছেন, আমরা তাকে দেখেছি। কিন্তু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যে তার কথা একদম ভুলে গেছি, সে কথা জানতে পারেন নি। কথা শেষ করে সায়মা আবার হেসে উঠল।
রূপা ধমকের স্বরে বলল, এতে হাসবার কী হল?
সায়মা হাসি মুখেই বলল, বারে, এটা হাসির ব্যাপার নয় তো কী? তুই গেলি তোর প্রেমিককে দেখতে, তাকে দেখার কথা ভুলে নিজের গায়ের ওড়না ছিঁড়ে অন্য আর একজনের হাত বেঁধে দিলি। তারপর তাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলি। এসব দেখে তোর বেচারা প্রেমিক নিশ্চয় ভাববেন, ছেলেটা তোর লাভার। অবশ্য কাজিনও ভাবতে পারেন।
রূপা রেগে উঠে বলল, তুই সময় সময় এমন আজে বাজে কথা বলিস, যা শুনে গা জ্বালা করে।
গা জ্বালা করুক আর অন্য কিছু করুক, রাতে ফোন এলেই বুঝতে পারবি। তোর বন্ধ কর তো, কান ঝালাপালা হয়ে গেল।
আমি কিছু বললেই বকবকানি হয়, আর নিজে যে পদে পদে ভুল করছিস, তা শুধরাবে কে?
রূপা একটু অবাক হয়ে বলল, আমি পদে পদে ভুল করছি মানে?
ছেলেটার নাম ঠিকানা নিয়েছিস? কেমন থাকেন না থাকেন জানার জন্য অন্ততঃ টেলিফোন নাম্বারটা নেওয়া উচিত ছিল নয় কী?
রূপা ভুলটা বুঝতে পারল। নরম স্বরে বলল, শুধু আমাকে দুষছিস কেন? তুই
তো জেনে নিতে পারতিস?
সবকিছুই জানতে আমার ইচ্ছা হয়েছিল; কিন্তু তুই কিছু মনে করতে পারিস ভেবে জিজ্ঞেস করি নি।
আমি আবার কী মনে করব?
যেভাবে ছেলেটার প্রতি দরদ দেখালি, ভাবলাম, তাকে তোর মনে ধরেছে, তুই তার পরিচয় নিবি। তাই তোকে ডিঙ্গিয়ে কিছু জানতে চাই নি।
রূপা হেসে উঠে বলল, এতদিন বলে এলি আমি আব্দুস সাত্তার সাহেবের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। একটু আগেও তাকে আমার প্রেমিক বলে উল্লেখ করলি। এখন বলছিস এই ছেলেটাকে পছন্দ করি। তোকে পাকা বলে ভুল করেছি। আসলে তোর বুদ্ধি একদম কাঁচা।
তা হলে আর একটা কাঁচা বুদ্ধির পরিচয় দিই, তাড়াতাড়ি আসরের নামায পড়ে নিই আয়, নচেৎ কাযা হয়ে যাবে। তারপর আপুকে কথা বলার সুযোগ না। দিয়ে অজু করার জন্য সায়মা বাথরুমে ঢুকল।
০৩. আজ পনের দিন হয়ে গেল
আজ পনের দিন হয়ে গেল রূপা আব্দুস সাত্তারের ফোন পায় নি। প্রতিদিন রাত একটা পর্যন্ত ফোনের অপেক্ষায় থাকে।
সায়মা রাত বারটা একটা পর্যন্ত পড়ে। তার সঙ্গে রূপাও কোনো দিন গল্পের বই, আবার কোনো দিন কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ে। সায়মা ঘুমিয়ে পড়ার পরও আব্দুস সাত্তারের ফোনের আশায় একটার পর বিছানায় শুয়ে জেগে থাকে।
সায়মা ব্যাপারটা প্রথম দিকে জানতে পারে নি। জানার পর একদিন ঘুমাবার সময় জিজ্ঞেস করল, কিছু অনুমান করতে পারলি?
।সায়মা কী জানতে চাচ্ছে, রূপা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে বলল, কী অনুমান করব?
অত আর ন্যাকামী করিস না। তুই যে আব্দুস সাত্তারের ফোনের আশায় রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত জেগে থাকিস, তা আমার অজানা নেই।
রূপা চিন্তা করল, ও যখন জেনেই গেছে তখন আর মিথ্যে করে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবু ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, তুই কী আব্দুস সাত্তার সাহেবের কথা বলছিস?
তা নয় তো কী সেই গুলি খাওয়া ছেলেটার কথা বলছি?
আমার মনে হয়, ঐদিন কোনো কারণে আব্দুস সাত্তার সাহেব আসতে পারেন নি। তাই লজ্জায় হয়তো ফোন করেন নি।