রোকন উদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তখন যে সব কথা বললি, তা শুনে আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। আমি আব্দুল হামিদের সঙ্গে খুব শিঘ্রী দেখা করে মাফ চাইব।
তাসনিম আলুর দুটো হাত ধরে আপ্লুতকণ্ঠে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আল্লাহ চাহে তো এবার আমরা আমাদের আব্বকে ছোটবেলার মতো দেখতে পাব। এমন সময় মাকে আসতে দেখে বলল, আম্মু, আব্ব কি বলল। শুনেছ?
মুমীনা বেগম হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ শুনেছি। তোর আব্ব আমাকে আগেই বলেছে। আব্দুস সাত্তারকে কালকেই নিয়ে আসবি। সেদিন কিছু না খেয়ে চলে গেছে।
এত তাড়াতাড়ি ও এত সহজে আব্বুর মন পাল্টে যাবে তাসনিম কল্পনাও করে নি। মনে মনে আবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে তার চোখে পানি এসে গেল। সেই অবস্থায় আব্বুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
রোকন উদ্দিন সাহেবের হাত তখনও তাসনিমের মাথায় ছিল। নাড়া দিয়ে। বললেন, হ্যাঁরে মা, তোর আম্মু ঠিক কতা বলেছে।
তাসনিম চোখ মুছে বলল, ও তো এখন ঢাকায় নেই। পনের ষোল দিন হল দেশের বাড়িতে গেছে। ওর আম্মুর খুব কঠিন অসুখ।
রোকন উদ্দিন সাহেব আতঙ্কিত স্বরে বলরেন, তাই নাকী? তা হলে তো দু’একদিনের মধ্যে আমাকে যেতে হবে। ওঁর কাছেও আমি অনেক ঋণী, মাফ চাইতে হবে।
স্বামী থেমে যেতে মুমীনা বেগম বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। উনি আমাকে মায়ের পেটের বোনের মতো মনে করতেন। তুমি দু’একদিনের মধ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।
রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, এর মধ্যে তুই কোনো খবর পাস নি?
না।
ঢাকার বাসায় ফোন করে জানিস নি?
ফোন করেছি, কিন্তু বাসায় কেউ নেই। শুধু কাজের বুয়া জমিলা আছে। সে কিছু বলতে পারে না।
ঠিক আছে, তুই এখন যা। ভেবে দেখি, কবে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
তাসনিম ফিরে এসে সায়মাকে বসে থাকতে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর কথাই ঠিক। আব্ব পাল্টে গেছে। তারপর সব কথা বলল।
সায়মা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আমার আপু আল্লাহর খাটি বান্দি। তাই, তিনি তার দোয়া কবুল করেছেন। কাল আমাকে দেখতে আসবে, তারা যদি পছন্দ করে ফেলে, তা হলে তো দু’চার দিনের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলেটা কেমন হবে ভেবে খুব ভয় পাচ্ছি। তুই একটু দোয়া করে দে, যেন ছেলেটা ভালো হয়। তোর দোয়া নিশ্চয় আল্লাহ কবুল করবেন।
তাসনিম তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তোর সবটাতে দুষ্টমী। ঠিক আছে, দোয়া করছি, শুধু ছেলেটা নয়, তার মা-বাবাও যেন ভালো হয়। তারপর হেসে ফেলে বলল, হলো তো?
এমন সময় ফোন বেজে উঠতে দু’জনেই ঘড়ি দেখল, এগারটা।
সায়মা বলল, নিশ্চয় আব্দুস সাত্তার ভাই? কোনো কারণে সময়ের আগেই ফোন করেছেন।
তাসনিম হেসে উঠে বলল, সাহেব না বলে ভাই বললি যে?
সায়মাও হেসে উঠে বলল, বলব না? কয়েকদিন পরে শুধু ভাই নয় দুলাভাই বলতে হবে তো? তাই এখন থেকে অভ্যাস করছি।
তাসনিম হাসি থামিয়ে ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, তাসনিম বলছি?
আব্দুস সাত্তার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছ?
আনন্দে তাসনিমের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সামলাবার চেষ্টা করল।
কী হল? কথা বলছ না কেন? এতদিন যোগাযোগ করি নি বলে খুব রাগ হয়েছে? না অভিমান হয়েছে? যাই হোক না কেন ক্ষমা চাইছি।
তাসনিম বলল, তোমার জান এত শক্ত কেন? আমার উপর ঝড় বইতে শুরু করেছে জেনেও এতদিন একটুও খোঁজ খবর নিলে না।
সে কথা পরে বলব, আগে বল, ঝড়ের বেগ কমেছে, না বেড়েছে?
তার আগে বল খালাআম্মা কেমন আছেন?
আম্মু একটু ভালো; কিন্তু দাদিআম্মা ভালো না। তিনি তার একমাত্র নাতির বৌ দেখে মরতে চান। তাই তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। ঝড়ের খবর বল।
আজ মাগরিবের নামাযের পর দু’শ মাইল বেগে বয়ে গেছে।
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, বাজে কথা।
কী? আমি বাজে কথা বলছি?
আহা, চটছ কেন? বাজে কথা মানে ঝড়ের বেগ যা বললে তা ঠিক নয়। বিশ পঁচিশ মাইল হতে পারে, সেই কথা বোঝাতে চেয়েছি।
কী করে বুঝলে?
তোমার গলার স্বরই বলে দিচ্ছে।
তাই যদি হয়, কাল সকালে আসতে পারবে?
কেন পারব না? তা ছাড়া তোমাকে যখন নিয়ে যেতে এসেছি তখন পাঁচশ মাইল বেগে ঝড় বইলেও কাল তোমাদের বাসায় যেতে হবেই। কাল তোমাকে নিয়ে কাজী অফিসে কাবিন করব। পরশু দেশের বাড়ি রওয়ানা দেব। কাল আরো কিছু কাজ সারতে হবে।
তার কথা শুনে আনন্দে তাসনিমের বুকের রক্ত আবার ছলকে উঠল। সামলাবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
আব্দুস সাত্তার অধৈর্য গলায় বলল, চুপ করে আছ কেন? আমার সঙ্গে যাবে না?
তোমার কী মনে হয়?
একশ পার্সেন্ট সিওর, তুমি যাবে।
তা হলে জিজ্ঞেস করছ কেন?
বিয়ের ব্যাপারে ছেলেকে প্রথমে মেয়ের কাছে প্রস্তাব দিতে হয় বলে।
তার আগে তো মেয়ের গার্জেনদের কাছে প্রস্তাব পাঠাতে হয়?
কাল সকালে গিয়ে তোমার গার্জেনদের কাছে প্রস্তাব দেব। তোমার মতামত নিয়ে দিলে তো ওরা অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দেবেন?
গার্জেনরা যদি প্রস্তাব নাচক করে দেন?
তুমি আমার ফরে থাকলে নাচক করে দিলেও রাজি করার জন্য কূটনৈতিক চাল চালব। আশা করি, ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হব।
নিজের প্রতি এতই তোমার বিশ্বাস?
নিজের প্রতি যা আছে, আল্লাহর উপর তার চেয়ে লক্ষগুণ বেশি আছে।