রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়ের কথা শুনে এত অভিভূত হলেন যে, কোনো কথা বলতে পারলেন না। তাসনিমের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সায়মা আবু আম্মুর দিকে ভয়ে ভয়ে একবার তাকিয়ে রিডিংরুমে এসে পড়তে বসল। কিন্তু পড়ায় মনোযোগ দিতে পারল না। ভোলা বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আপুর কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। একসময় ভাবল, আপু এত সাহস পেল কোথায়? মনে হয় প্রেমে পড়লে সাহস বেড়ে যায়। কথাটা ভেবে নিজে নিজে হেসে উঠল।
তাসনিমের কথা শুনে রোকন উদ্দিন সাহেবের রাগ পড়ে গেল। সেই সাথে কুরআন-হাদিসের বাণী শুনেও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। কোনো কথা বলতে না পেরে তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। দুই মেয়েকে চলে যেতে দেখেও কিছু বললেন না।
মুমীনা বেগম বড় মেয়ের কথা শুনে খুব খুশী হয়েছেন। স্বামীর মনের অবস্থা অনুমান করতে পেরে বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে, তাসনিম খুব ভালো কথা বলেছে। বিয়ের ব্যাপারে এখন আর ওকে কিছু বলল না। তোমার বন্ধু যে। ছেলেটার কথা বলেছেন, কাল তারা এলে সায়মাকে দেখাও, তারা যদি ওকে পছন্দ করে, তা হলে তাসনিম যা বলল, সেই ব্যবস্থা করাই আমি ভালো মনে করি।
রোকন উদ্দিন সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তাসনিম যে এত কুরআন-হাদিসের জ্ঞান রাখে, তা জানতাম না। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, আব্দুল হামিদের সঙ্গে যা কিছু করেছি তা সত্যিই আমি ভুল করেছি। তাসনিম মস্তবড় গুনাহর থেকে বাঁচার পথ দেখাল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আব্দুল হামিদের। কাছে ক্ষমা চাইব।
মুমীনা বেগম খুব আনন্দিত হয়ে বললেন ও অনেক আগে থেকে। কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও ধর্মীয় নানারকম বইপত্র পড়ে, জানবে না কেন? ওতো বেশ কিছুদিন আগে থেকে বোরখা পরে বাইরে যায়।
যারা ধর্মীয় বইপত্র পড়ে, তারা বোরখা পরতে বাধ্য হবে। এখন ওসব কথা থাক। ভাবছি, ওরা কাল এলে সায়মাকেই দেখাব।
আমিও তো তাই বললাম। তবে তার আগে সায়মার মতামত নিতে হবে।
কেন? ও আবার কাউকে ভালবাসে নাকী?
তা জানি না। আজ খাওয়ার পর তাসনিমকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। সে রকম কিছু হলে তাসনিম জানবেই।
.
খাওয়ার টেবিলে তাসনিম নেই দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বুঝতে পারলেন, রাগ করেছে। সায়মাকে বললেন, তাসনিমকে ডেকে নিয়ে আয়। না আসতে চাইলে বলবি, না এলে আমিও খাব না।
তাসনিম এশার নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সায়মা এসে জাগিয়ে বলল, আপু, ভাত খাবি চল।
তাসনিম বলল, খেতে ইচ্ছা করছে না। তোরা সবাই খেয়ে নে।
খাওয়ার টেবিল থেকে আলু তোকে ডাকতে পাঠাল।
গিয়ে বল, আমি খাব না।
তুই না খেলে আব্বুও খাবে না বলল।
তাসনিম জানে, সে না খেলে আব্বুও খায় না। তাই বলল, যাচ্ছি, তুই যা। তারপর উঠে বাথরুমে থেকে এসে খাওয়ার টেবিলে এল।
রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, কীরে মা, ছেলেকে বকা দিয়ে নিজেই রাগ করলি?
তাসনিম কিছু না বলে খেতে শুরু করল।
অল্প খেয়ে উঠতে দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, কিছুই খেলি না যে? বুড়ো ছেলের উপর এখনও রেগে রয়েছিস তা হলে?
তাসনিমের কান্না পাচ্ছিল আব্বুর কথা শুনে। তাই কিছু না বলে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে চলে যাচ্ছিল। আব্বুর গলা শুনতে পেল, একটু পরে আমার কাছে আসবি।
তাসনিম রুমে এসে চিন্তা করল, আব্বুর সুর অন্য রকম মনে হল। তা হলে আল্লাহ কী তার দোয়া কবুল করেছেন? আবার ভাবল, এটা একটা চাল নয় তো? যদি তাই হয়, তা হলে কি বলবে চিন্তা করতে লাগল।
এমন সময় সায়মা এসে বলল, তুই যখন আব্বকে ঐসব কথা বলছিলি তখন যেমন খুব ভয় পেয়েছিলাম, তেমনি তোর সাহস দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আমি হলে তো লজ্জায় ও ভয়ে কোনো কথাই বলতে পারতাম না। তবে কথাগুলো বলে খুব ভালো করেছিস। মনে হচ্ছে আব্বুর মন চেঞ্জ হয়েছে।
কী করে বুঝলি?
আলুর কথা শুনে তুই কিছু বুঝতে পারিস নি?
আমাকে বোঝবার জন্য একটা চাল হতে পারে?
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। সত্যিই আব্বুর মন চেঞ্জ হয়েছে।
তোর এরকম হওয়ার কারণ?
তুই চলে আসার পর আব্ব ও আর খেল না। মুখ হাত দুয়ে চলে গেল। আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কাউকে পছন্দ করি কিনা?
তাসনিম কপাল কুঁচকে বলল, তুই কী বললি?
আমি আবার কী বলব? বললাম নেই।
আম্মু আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি?
জিজ্ঞেস করে নি, তবে বলল, “তোর আপু যখন এখন বিয়ে করবে না বলছে তখন কাল যারা আসবেন, তাদেরকে তোকে দেখাব।”
তাসনিম চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছিস?
সত্যি না মিথ্যে আব্ব তো তোকে তার রুমে যেতে বলেছে, গেলেই জানতে পারবি।
তুই আম্মুকে কিছু বলিস নি?
আপাততঃ এই বিপদ থেকে তুই রক্ষা পাবি ভেবে বলেছি, “আমার কোনো আপত্তি নেই।”
তাসনিম তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তুই আমাকে এত ভালবাসিস? দোয়া করছি, “আল্লাহ তোকে সুখী করুক।” তারপর। তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বলল, যাই, আব্ব কেন ডেকেছে শুনে আসি।
তাসনিমকে দেখে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, আমার কাছে এসে বস। বসার পর তার মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, এত কুরআন হাদিস জানিস, আর এটা জানিস না, মা-বাবার মনে কষ্ট দেওয়া বড় গুনাহ?
তাসনিম বলল, তা জানব না কেন? জানি বলেই তো এত কিছু বলে বোঝালাম। নচেৎ তোমাদেরকে না জানিয়ে এতদিনে আমরা বিয়ে করে ফেলতাম।