আব্বু থেমে যেতে তাসনিম বলল, কিন্তু আমি তো এখন বিয়ে করব না। আব্দুস সামাদ চাচা যখন ছেলে ও ছেলের মা বাবার সম্পর্কে ভালো সার্টিফিকেট দিয়েছেন তখন সায়মার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও। ওর তো দু’মাস পরে পরীক্ষা। পরীক্ষার পর স্বামীর কাছে চলে যাবে।
রোকন উদ্দিন সাহেব রেগে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, সায়মার ব্যাপারে তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই এখন বিয়ে করবি না কেন?
আমি যাকে ভালবাসি, তাকে ছাড়া বিয়ে করব না।
রোকন উদ্দিন সাহেব উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, তুই কী সেই রাজাকারের ছেলের কথা বলছিস?
হ্যাঁ আব্বু, তাকে যদি তোমাদের পছন্দ না হয়, চিরকুমারী থাকব।
রোকন উদ্দিন সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আরো উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, শুনেছ তোমার বড় মেয়ের কথা? ও সেই রাজাকারের ছেলেকে ছাড়া বিয়ে করবে না? তারপর তাসনিমকে বললেন, আমাদের কোনো পুত্র সন্তান নেই। তাই তোদের সব আবদার পূরণ করি। তাই বলে রাজাকারের ছেলের হাতে তোকে দেব, এটা ভাবলি কী করে? দুনিয়া এদিক ওদিক হয়ে গেলেও তা সম্ভব নয়। তারপর স্বর নামিয়ে বললেন, তুই একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হয়ে বাবার মান সম্মানের দিকে একটু খেয়াল করবি না? ওকে ভুলে যা মা, ভুলে যা। ওর হাতে কিছুতেই তোকে তুলে দিতে পারব না।
আব্বুকে নরম হতে দেখে তাসনিমের সাহস বেড়ে গেল। বলল, কেন পারবে আব্বু? রাজাকার ছিলেন তোমার বন্ধু। দোষ করলে তোমার বন্ধু করেছেন। তার ছেলে তো করে নি। তা ছাড়া আমরা যাদেরকে রাজাকার বলে জানি, তিনি। তা ছিলেন না। আমার এক বান্ধবী আছে, তার বাবাকেও গ্রামের লোক রাজাকার বলত। তিনি গ্রামে টিকতে না পেরে সবকিছু বিক্রি করে ঢাকায় এসে বসবাস করছেন। তার মুখে শুনেছি, তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিলেও নিজের ও আশপাশের গ্রামের লোকজনদের পাক বাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। তবু তাকে সবাই রাজাকার বলত। জেনেছি, তোমার বন্ধুও তাই করেছেন। এরকম ধরনের রাজাকার অনেক আছেন। যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন যে দল সরকার হয়েছে, সেসব দলে ভীড়ে বড়বড় পদে কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন। একটা জিনিস ভাবছ না কেন? প্রত্যেক সরকারের কমবেশি জনগোষ্ঠী সমর্থক থাকে। যারা সব সময় সরকারের পক্ষে কাজ করে। পাকিস্তান সরকারেরও ছিল। তারা পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন দেশের সরকারের আনুগত্য মেনে। নিয়েছে। একথা জানতে পেরে অথবা বুঝতে পেরে তকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক ক্ষমা পেয়েছে, যারা নাকি স্বাধীনতাি যুদ্ধের বিরোধী ভূমিকা করেছে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতে সহায়তা করেছে এবং এখনও তারা স্বাধীনতা বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এরাই সত্যিকার রাজাকার, এরাই দেশের চিরশত্রু। এদেরকে ধরে ফাঁসিতে ঝোলান উচিত। আর তাদেরকেও ফাঁসিতে ঝোলান উচিত, যারা মুসলমান হয়েও বারকোটি মুসলমানের দেশ থেকে ইসলাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
তোমার বন্ধু মুক্তিযুদ্ধ করেন নি, এটাই তার অপরাধ; কিন্তু তিনি তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেন নি। বরং যতটা সম্ভব লোকজনদের জান, মাল ও ইজ্জত বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য তার হাজার হাজার টাকা খরচও হয়েছে। সে সব খবর কেন নাও নি? তিনি কী তোমার শত্রু ছিলেন? জেনেছি, স্কুল জীবন থেকে তোমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুতু ছিল। তোমার উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার পেছনে তার ও তার বাবার অবদান কম ছিল না। সে সব কথা ভুলে গিয়ে ও তার। কর্মকাণ্ডের খোঁজ খবর না নিয়ে কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন নি বলে এত বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। বন্ধুত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি সবকিছু জানিয়ে ক্ষমা চাইতে তোমার কাছে রাতের অন্ধকারে কয়েকবার এসেছিলেন; কিন্তু তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অপমান করে প্রতিবারেই তাড়িয়ে দিয়েছ। এটা উচিত না অনুচিত হয়েছে, ভেবে দেখেছ কোনো দিন?
তুমি জান কিনা জানি না, হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “তিন দিনের অতিরিক্ত কোনো মুসলমানের পক্ষে তাহার ভ্রাতাকে পরিত্যাগ সে কোন বনের হরিণ ৭ করিয়া থাকা হালাল নহে। যে তিন দিবসের অতিরিক্ত তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে অতঃপর তাহার মৃত্যু হয়, সে দোযখে যাইবে(১)।”
আল্লাহ কুরআনে বলিয়াছেন, “মুমিনগণ তো সকলেই (পরস্পর) ভাই, সুতরাং তোমাদের ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে সন্ধি করাইয়া দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর, যেন তোমাদের প্রতি দয়া বর্ষিত হয়(২)।”
সে হিসাবে আব্দুস সাত্তারের বাবা তোমার ভাই। তার উপর তিনি তোমার বন্ধু ছিলেন। বন্ধু আত্মীয়ের সমান। আত্মীয়তা ছিন্ন করাও কবিরা গুনাহ। হাদিসে আছে, নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “বিদ্রোহ ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ব্যতীত আর অন্য কোনো গুনাহ নাই, যাহার জন্য আখিরাতে শান্তি অবধারিত থাকা সত্ত্বেও এই পৃথিবীতে তাহার শাস্তি হয়(৩)।”
আমি তোমাদের মেয়ে। কথা না শুনলে আমাকে তোমরা যা ইচ্ছা তাই শাস্তি দিতে পার। তবু বলব, আব্দুস সাত্তারকে ভাল না বাসলেও তোমার ও তার আব্বার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কথা জানার পর যেমন করে হোক সেই সম্পর্ক জোড়া দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম এবং এখনও তাই করব। আমার শেষ কথা তোমরা শুনে নাও, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে আমাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আরা একটা কথা না বলে পারছি না, ছোটবেলায় আমরা যে আলুকে দেখেছি, বড় হয়ে সেই আন্ধুকে আবছা আবছা দেখতাম। মন্ত্রী হওয়ার পর তাও দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মুখের উপর অনেক কিছু বলে খুব বড় বেয়াদবি করে ফেললাম। সেজন্য মাফ চাইছি। তারপর সেখানে থেকে নিজের রুমে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।