তাসনিম কিছুক্ষণ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলল; তারপর চোখ মুছে আব্বর রুমে গিয়ে দেখল, আম্মু ও সায়মা রয়েছে। তিনজনেরই মুখ খুব গম্ভীর।
রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, ওর সঙ্গে আর কোনো দিন মেলামেশা করবি।
কেন আব্বু?
তুই ওর পরিচয় জানিস?
জানি।
কী জানিস বলতো?
তাসনিম আব্দুস সাত্তারের সবকিছু বলল।
কিন্তু ওর বাবা যে রাজাকার ছিল, তা তো জানিস না?
তাতে কী হয়েছে? ওর বাবা রাজাকার ছিলেন, উনি তো ছিলেন না?
রোকন উদ্দিন সাহেব রেগে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনেছ তোমার মেয়ের কথা? তারপর তাসনিমকে বললেন, মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হয়ে একজন রাজাকারের ছেলের হয়ে কথা বলতে তোর লজ্জা করল না?
ওকে আমি ভালবাসি আব্বু।
রোকন উদ্দিন সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, চুপ, আর একটা কথা বলবি না। তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে চাবকে। পিঠের ছাল তুলে নিতাম। তারপর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওকে বুঝিয়ে বলে দিও, এরকম দুঃসাহস যেন আর কখনও না দেখায়। এই কথা বলে বেরিয়ে গেলেন।
মুমীনা বেগম তাসনিমকে বললেন, তোর আব্বুর কথা শুনলি তো? ঐ ছেলেকে তুই ভুলে যা মা।
আব্বুর কথা শুনে তাসনিম মনে খুব ব্যথা পেল। চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। কিছু না বলে নিজের রুমে ফিরে এল।
সায়মা তার পিছু পিছু এসে বলল, আপু, উনি যে রাজাকারের ছেলে, কই, তুই তো আমাকে বলিস নি? বললে অনেক আগেই বাছাধনকে প্রেম করা বের। করে দিতাম। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই কী আগে জানতিস?
না, কাল বলেছে।
দেখলি তো, উনি কত বড় ফ্রড? তোকে প্রেমের সাগরে ভাসাবার পর জানালেন। তুই ঘৃণা করবি ভেবে আগে জানাই নি। আমি হলে কাল জানার পর। মুখে থুথু ছিটিয়ে চলে আসতাম। আর তুই কী না ওকে এখনও ভালবাসিস। লজ্জায় মাথা খেয়ে আবুকেও আবার সে কথা বললি। ছিছি আপু, কোন মুখে। আব্বুকে কথাটা বলতে পারলি?
তার কথা শুনে তাসনিম প্রচণ্ড রেগে গেল। ইচ্ছা করল, তার গালে কষে একটা চড় মারতে। ইচ্ছাটা দমন করার জন্য উপরের পাটির দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে রাগ সামলাবার চেষ্টা করল। রাগের চোটে চোখে পানি চলে এল।
তার চোখে পানি দেখে সায়মা বলল, একটা ফ্রড ছেলের জন্য কাঁদা তোর উচিত হচ্ছে না?
তাসনিম গর্জে উঠল, ওকে বার বার ফ্রড বলবি না। বললে চড়িয়ে গাল লাল করে দেব বলে হাত উঠাল। পরক্ষণে নামিয়ে নিয়ে কান্নাজড়িত স্বরে বলল, সবকিছু না জেনে কারো বিরুদ্ধে কমেন্ট করা মুর্খতা। এতদিন পরিচয় না বলার মধ্যে যে কত বড় মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, তা যদি জানতিস, তা হলে ফ্রড বলতে পারতিস না। এতদিন আমার চেয়ে তুই-ই তার বেশি প্রশংসা করেছিস। রাজাকারের ছেলে জেনে এখন তাকে ঘৃণা করছিস। এটা ভাবছিস না কেন, রাজাকার ছিল তার বাবা, সে নয়। সব থেকে বড় কথা, সে যেই হোক না কেন, তাকে আমি আমার জীবনের সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালবাসি। কথাটা তুইও জানিস। একটা কথা জেনে রাখ, ও যদি চোর, ডাকাত, খুনীও হত, তবু ওকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করতে পারতাম না। ওর জন্য চিরকুমারী যদি থাকতে হয়, তাও থাকব। তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমাকে তুই যা কিছু ভাবতে পারিস, কিন্তু ওর সম্পর্কে আমার কাছে কোনো খারাপ কমেন্ট করবি না।
আব্দুস সাত্তার রাজাকারের ছেলে জেনে তার ও তাসনিমের উপর সায়মার যে ঘৃণা ও রাগ জন্মেছিল, আপুর কথা শুনে তা দূর হয়ে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে মাফ করে দে আপু। ওর সম্পর্কে সবকিছু না জেনে খারাপ কমেন্ট করে অন্যায় করেছি। বল, মাফ করে দিয়েছিস?
সায়মার কথাগুলো তাসনিমের কানে কান্নার মতো শোনাল। বলল, আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুক। এবার ছাড়।
সায়মা ছেড়ে দিয়ে বলল, আব্দুস সাত্তারের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বল না আপু, শুনব।
আম্মু ওদের সম্পর্কে অনেক কিছু নিশ্চয় জানে। ডেকে নিয়ে আয়, তার সামনে বলব। তা হলে সত্য মিথ্যা জানতে পারবি।
সায়মা মুমীনা বেগমকে ডেকে নিয়ে আসার পর তাসনিম বলল, বস আম্মু, আমি কয়েকটা কথা বলব। তোমরা আমাকে দু’টুকরো করে কেটে মাটিতে পুঁতে ফেল আর নদীতে ভাসিয়ে দাও, তবু আমি আব্দুস সাত্তারকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আর আল্লুকে বলে দিও, সে যদি আব্দুস সাত্তারের কোনো। ক্ষতি করে, তা হলে আমারও মরা মুখ দেখবে তোমরা। তারপর আব্দুস সাত্তারের আব্ব ও তার আব্বুর সম্পর্ক ও কি কারণে সম্পর্ক ছিন্ন হল সেসব বলে বলল, আব্দুস সাত্তার চায়, সেই পুরানো সম্পর্ক আবার প্রতিষ্ঠিত করতে। সেই জন্যে সে এতদিন তার পরিচয় দেয় নি। আমিও তাই চাই।
সায়মা মাকে জিজ্ঞেস করল, এসব কী সত্যি আম্মু?
মুমীনা বেগম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সত্যি তো বটেই। বরং আরো এমন সত্য ঘটনা আছে। যা আব্দুস সাত্তার হয়তো জানে না বলে বলে নি।
সায়মা বলল, সেই ঘটনাগুলো বল না আম্মু শুনি।
মুমীনা বেগম বললেন, আব্দুস সাত্তারের বাবা আব্দুল হামিদ ভাই খুব উঁচু মনের মানুষ। ওদের আর্থিক অবস্থা অনেক আগের থেকে খুব ভালো। তোর। আব্বুর সঙ্গে আব্দুল হামিদ ভাইয়ের এত গভীর বন্ধুত্ব ছিল যে, যা তোরা কল্পনা করতে পারবি না। আব্দুস সাত্তারের দাদা দাদিও খুব উঁচু মনের মানুষ ছিলেন। তারা তোদের আন্ধুকে নিজের ছেলের মতো মনে করতেন। তোদের দাদার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আব্দুল হামিদ ভাইয়ের বাবার সাহায্যে তোদের আব্ব এত লেখাপড়া করেছে। তোদের আলু অনেকবার আমাকে ওদের বাড়িতে। নিয়ে গেছে। আব্দুস সাত্তারের মাও খুব ভালো মহিলা। অত বিত্তশালী ঘরের বৌ হলেও এতটুকু অহঙ্কার নেই। আমার সঙ্গে সই পাতিয়েছিলেন। তারপর কি করে সম্পর্ক ছিন্ন হল, তা তো তোরা জেনেছিস। আমি তোদের আব্বকে অনেকবার বলেছি, মিলমিশ করার জন্য, কিন্তু ওর একটাই কথা, “যে ইচ্ছা করে মুক্তিযুদ্ধ। করে নি এবং পাকিস্তান সৈন্যদের সাহায্য করেছে, সে রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একজন রাজাকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমাদের সম্পর্কের কথা লোকজন যখন জানবে তখন তাদের কাছে মুখ দেখাব কি করে?” তোদের আব্বুর কথা শুনে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমি কিছুই। বলতে পারি নি।