তাসনিম চোখ মুখ মুছে বলল, তুমি রাজাকারের ছেলে জেনে প্রচণ্ড আঘাত পাই নি। পেয়েছি, এতদিন কথাটা জানাও নি বলে। আর চোখের পানি ফেলেছি, তুমি আমার ভালবাসাকে খুব হালকাভাবে নিয়েছ বলে। একটা কথা মনে রেখ, তুমি আব্বুর শত্রুর ছেলে হও আর রাজাকারের ছেলে হও, তাতে আমার ভালবাসা একবিন্দু কমবে না। আমার ভালবাসাকে বিশ্বাস করতে পার নি জেনে খুব কষ্ট পাচ্ছি। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
বিশ্বাস কর তাসনিম, তোমার ভালবাসার এতটুকু অবিশ্বাস করি নি। শুধু জানান উচিত ভেবে বলেছি। আর তোমাকে চিন্তা করার ও তোমাদের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে যা বলেছি; তা সাত সমুদ্রের জলরাশির গভীরতা পরীক্ষা করার জন্য একটু দুষ্টুমী করেছি। এতে যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তা হলে ক্ষমাপ্রার্থী। প্লীজ তাসনিম, ক্ষমা করে দাও। আর তা না হলে, যা ইচ্ছা বলে আমারও পরীক্ষা নাও।
তাসনিম সামলে নিয়ে বলল, আমার ভালবাসার পরিধি ও গভীরতার চেয়ে তোমার যে কয়েক সহস্রগুণ বেশি, তা অনেক আগেই জেনেছি। পরীক্ষা করলে আমিই ঠকে যাব। আর ক্ষমা করার কথা যে বললে, তার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তুমি যে আমার ভালবাসাকে পরীক্ষা করেছ, তা বোঝা আমারই উচিত ছিল। এবার আমি দু’একটা প্রশ্ন করি?
আব্দুস সাত্তার মৃদু হেসে বলল, অফকোর্স।
তুমি সারাদিন কি এত কাজ কর যে, রাতে খুব টায়ার্ড ফিল কর? প্রশ্নটা অবশ্য কাল রাতেই করেছিলাম।
সুস্থ হওয়ার পর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করতে হয়।
তাসনিম খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি চাকরি কর?
না।
তা হলে?
নিজের অফিস।
কোনো ব্যবসা শুরু করেছ?
না।
তা হলে খোলাখুলি বলছ না কেন?
বললে রাগ করবে না বল?
না করব না।
সবকিছু বলতে গেলে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। তুমি কিন্তু এখনও বাসায় ফোন কর নি।
টেবিলের উপর টেলিফোন সেট দেখে তাসনিম বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিল, “দুপুরে এক বন্ধুর বাসায় খাবে। বিকেলে ফিরবে।” তারপর রিসিভার রেখে। বলল, এবার বল।
আব্বুর নাম আব্দুল হামিদ ছাড়া আমার পুরো বায়োডাটা তোমাকে আগে বলেছি। তারপর ফুফা-ফুফুর সম্পর্ক ও কিভাবে সে এখানে, এল এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হল, সবকিছু বলে বলল, পরীক্ষার পর অফিস করছিলাম। দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পাঁচ মাস অফিস করতে পারি নি। সুস্থ হওয়ার পর অফিসে গিয়ে দেখি প্রচুর কাজ পড়ে আছে। তা ছাড়া ম্যানেজার চাচা আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বলেছেন, এবার আমাকেই অফিস চালাতে হবে।
তাসনিম জিজ্ঞেস করল, এতবড় এ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির তত্ত্বাবধান কে করে?
গেটের পাশে দু’টো রুম দেখেছ না? ওটা একটা অফিস। তিনজন লোক কাজ করে। ওদের উপরেই দায়িত্ব দেওয়া আছে। আগে ফুফা শুধু হিসাব চেক করতেন। এখন আমি করি।
তুমি তো জানতে আব্ব কিছুতেই রাজাকারের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না, তবু কেন আমাকে ভালবাসলে?
তুমি জান কিনা জানি না, সত্যিকার প্রেম ভালবাসা আল্লাহর ইশারাতেই হয়। অবশ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই তারই ইশারাতে হয়। আমাদের ব্যাপারটাও তাই। তা না হলে ছ’মাসের ব্যবধানে মাত্র দু’বার দেখে তোমার প্রতি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লাম কেন? তারপর বায়োডাটা জেনে এত হতাশ হয়ে পড়লাম যে, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম হারাম হতে বসেছিল। তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য ছ’মাস আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। শরীর ও মন খুব ভেঙ্গে পড়ল। আল্লাহর ইশারায় হঠাৎ একদিন একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ব্যাস, তারপর থেকে ফোন করতে শুরু করে এই পর্যন্ত এলাম। কথা শেষ করে আব্দুস সাত্তার মৃদু হাসল।
তাসনিমও মৃদু হেসে বলল, তা না হয় বুঝলাম, বুদ্ধিটা তো ব্যাখ্যা করলে না?
আমি মনে করেছি, বুদ্ধিটা বুঝতে পেরেছ। বলছি শোন, তোমার আমার বন্ধনের দ্বারা উভয়ের আব্বুর দুশমনির বাঁধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে পুনরায় বন্ধুত্বের বাঁধ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে দুশমনির অর্ধেক পথ ভেঙ্গেছি। আশা করি, তারই দয়ায় বাকি অর্ধেক ভেঙ্গে পুনরায় তাদের পুরোনো বন্ধুত্বের নতুন বাঁধ তৈরি করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
সুবহান আল্লাহ বলে তাসনিম বলল, তোমার এই মহৎ উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত হয়ে দোয়া করছি, “আল্লাহ আমাদের দু’জনকে কবুল করে এই মহৎ উদ্দেশ্য যেন সফল করান।” তারপর বলল, আচ্ছা, আব্বু পরিচয় জানার পর যদি তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন?
আব্দুস সাত্তার হেসে উঠে বলল, তাতো দেবেনই।
তাকে হাসতে দেখে তাসনিম অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
খুব অবাক হয়েছ না? ভাবছ, অপমান হওয়ার কথা শুনে হাসছি কেন? হ্যাঁ, তাই ভাবছি।
তুমি এত বোকা কেন? এটা তো সবাই জানে আগুনে হাত দিলে পুড়বেই। আমি জেনেশুনে হাত দিয়েছি। পুড়লে দোষ তো আগুনের না। পোড়ার কষ্ট তো আমাকে সহ্য করতেই হবে। রাজাকারের ছেলে হয়ে জেনেশুনে মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে ভালবেসেছি। তিনি তো অপমান করবেনই। আর সেই অপমান আমাকে সহ্য করতেই হবে। দুঃখ কষ্ট বা অপমান যখন পেতেই হবে তখন হাসিমুখে বরণ করাই তো পৌরুষ। আমি নিজের জন্য কিছু ভাবছি না, ভাবছি তোমার জন্য। উনি চেষ্টা করবেন আগুনে পানি ঢেলে ঠাণ্ডা করার। ঠাণ্ডা করার আরো অনেক। পদ্ধতি আছে। তুমি সেসব সহ্য করতে পারবে কি না ভেবে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। তাই মন খারাপের কথা বলেছিলাম।