উম্মে হাফসা যখন চিবুক ধরে রূপের প্রশংসা করছিলেন তখন থেকে তাসনিম লজ্জায় মুখ নিচু করেছিল। এখন লজ্জা একটু কমেছে। মুখ তুলে তার দিকে। তাকিয়ে বলল, জি, বাংলায় অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি।
আল্লাহ তোমাকে রূপের সাথে গুণও দিয়েছেন।
ততক্ষণে উম্মে কুলসুম আম্মুর সঙ্গে তাসনিমের ব্যাপারে যা আলাপ হয়েছিল, তার সারমর্ম সটকাটে ছোট ভাইয়াকে ফিস ফিস করে বলছিল। মায়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে যদি তোমার এতই পছন্দ তখন বৌ করে ঘরে নিলেই পার।
তাসনিম লজ্জা পেয়ে আবার মুখ নিচু করে নিল।
অত ভাগ্য কী আমাদের হবে?
ভাগ্যে কি আছে না আছে, তা আল্লাহ জানেন। মেয়ে যখন পাশে বসে আছে, মতামত নিতেও তো পার?
উম্মে হাফসা তাসনিমকে বললেন, তুমি তো আমার মেয়ের কথা শুনলে মা, আব্দুস সাত্তার সুস্থ হওয়ার পর একদিন বাসায় এস।
তাসনিম আরো বেশি লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করেই বলল, জুি আসব। তারপর দাঁড়িয়ে বলল, এবার আসি খালা আম্মা।
আর একটু বস। মনে হচ্ছে, তুমি নাস্তা না খেয়ে এসেছ। আমি নাস্তা নিয়ে এসেছি, ওদের সঙ্গে নাস্তা খেয়ে তারপর যাবে।
আজ নয় খালা আম্মা, অন্য দিন খাব অনেকক্ষণ এসেছি, আব্বু নাস্তার টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।
তা হলে তো আর জোর করব না। শোন, আব্দুস সাত্তার সুস্থ হওয়ার পর বাসায় আসতে বলেছি বলে যেন আবার মনে করো না, এখানে আসতে নিষেধ করেছি। কী? এখানে আসবে না?
তাসনিম মৃদু হেসে জ্বি আসব বলে সালাম বিনিময় করে বেরিয়ে এল।
.
রোকন উদ্দিন সাহেব প্রতিদিন সকাল আটটায় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে নাস্তা করেন। আজ এসে বড় মেয়েকে দেখতে না পেয়ে ছোট মেয়েকে বললেন, রূপাকে দেখছি না কেন?
সায়মা বলল, আপু ভোর সাড়ে ছ’টায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করতে বলল, এসে বলবে। বললাম, আব্ব তো তোকে নাস্তার। টেবিলে খুঁজবে, কী বলব? বলল, তার আগেই ফিরব। সঙ্গে যেতে চাইলাম নিল না।
তাই না কী? তা হলে তো এতক্ষণ ফিরে আসার কথা। এখন তো রাস্তায় যানজট নেই, তবু দেরি হচ্ছে কেন? কোনো অসুবিধায় পড়ল না তো? আচ্ছা, ড্রাইভারকে নিয়েছে?
না নেয় নি।
তা হলে তো খুব চিন্তার কথা। অত সকালে ড্রাইভারকে না নিয়ে একা বেরোন উচিত হয়নি।
এমন সময় তাসনিম এসে আব্বর শেষের কথা শুনতে পেয়ে বলল, কাছেই গিয়েছিলাম, তাই ড্রাইভারকে নিই নি।
রোকন উদ্দিন সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, আর কোনো দিন অত সকালে ড্রাইভার ছাড়া একা বেরোবি না। তা কোথায় গিয়েছিলি বল তো?
ইবনেসিনা ক্লিনিকে একজন রুগীকে দেখতে।
খেতে শুরু করে রোকন উদ্দিন সাহেব বললেন, নিশ্চয় রুগী তোর প্রিয় কেউ?
কী করে বুঝলে?
তা না হলে নাস্তা না খেয়ে অত সকালে কেউ কাউকে দেখতে যায়?
ঠিক বলেছ। জান আব্বু, ছেলেটার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসীরা চাদা নিতে এসেছিল। ছেলেটা প্রতিবাদ করে। যা হওয়ার তাই হল। সন্ত্রাসীরা ওকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যেতে চাইলে লোকজন প্রতিরোধ করতে গেলে দু’দলে যুদ্ধ হল! উভয়পক্ষের কয়েকজন করে আহত হল। ছেলেটার একটা পা ভেঙ্গে গেছে। ইবনেসিনায় চিকিৎসা চলছে।
ছেলেটা খুব সাহসী বল?
হ্যাঁ আব্ব, শুধু সাহসী নয়, শক্তিশালীও। কয়েক মাস আগে একদিন আমি ও সায়মা সংসদ ভবন চত্বরে গিয়েছিলাম। তিন চারটে বাজে ছেলে আমাদেরকে টিজ করছিল। ছেলেটা তখন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে তাদেরকে দ্রভাবে চলে যেতে বলল। ছেলেগুলো তর্ক করতে করতে এক পর্যায়ে তাদের একজন পিস্তল বের করে গুলি করল। ছেলেটা তড়িৎগতিতে সরে গেলেও গুলিটা কাঁধের কিছু মাংস নিয়ে বেরিয়ে গেল। তবু ছেলেটা ভয় পেল না। পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে ভাগিয়ে দিল। আশেপাশের অনেকে ঘটনাটা দেখলেও কেউ ছেলেটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। তারপর বাজে ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর যা কিছু হয়েছে বলে বলল, আমরা ছেলেটার কার্যকলাপে খুব অবাক হলাম। সব থেকে বড় কথা, তখন তাকে আমরা চিনতাম না।
রোকন উদ্দিন সাহেব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, বাহ, ছেলেটা সত্যিই খুব বাহাদুর। তা হারে, পরে ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?
ঐ ঘটনার কয়েকদিন পর সায়মার জুতো কেনার জন্য নিউমার্কেটে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ছেলেটাও তার বোনকে নিয়ে জুতো কিনতে এসেছিল। তখন থেকে পরিচয়।
মেয়ের কথাবার্তায় রোকন উদ্দিন সাহেব বুঝতে পারলেন, সে ছেলেটার প্রতি বেশ দুর্বল। বললেন, এতকিছু বললি, দেখতে কেমন, কতদূর লেখাপড়া করেছে উপার্জন-টুপার্জন করে কিনা, বাবা কি করেন, দেশের বাড়ি কোথায়, সেসব তো কিছুই বললি না?
প্রায় দু’আড়াই মাস মানসিক যন্ত্রণায় ভোগার পর আজ আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে সেই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছে। তাই তার মন আনন্দে আপ্লুত হয়েছিল। আব্বুর কথার ইঙ্গিত তাসনিম বুঝতে পারল না। স্বতস্ফূর্ত কণ্ঠে বলল, দেশের বাড়ি কোথায় জানি না। আর দেখতে দারুণ। ফর্সা টকটকে দোহারা গড়ন, প্রায় ছ’ফুট লম্বা। এ বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে। দেখলে তোমারও ভালো লাগবে।
রোকন উদ্দিন সাহেব মেয়ের মনের খবর এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলেন।