মাজেদ নামের নয় দশ বছরের একটা ছেলেকে দেয়া হয়েছে গা, হাতপা টিপে তাকে আরাম দেবার জন্যে। মিসির আলি তাকে সে সুযোগ দেন। নি। একটা মানুষ তার গা ছানাছানি করবে। এই চিন্তাই তাঁর কাছে অরুচিকর।
মনে হচ্ছে মাজেদিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার ঘরে কম্বল পেতে ঘুমানোর জন্যে। সে খাটের দক্ষিণ দিকে মহানন্দে বিছানা করছে।
মিসির আলি বললেন, মাজেদ! তুমি স্কুলে যাও?
জ্বে না স্যার।
যাও না কেন?
মাস্টার ভাল না। পিটন দেয়।
লেখাপড়া শিখতে ইচ্ছা করে না?
জ্বে না।
বড় হয়ে কি করবে? ক্ষেতের কাজ?
খলিফার কাজ শিখবা। সদরে দোকান দিব।
তোমার বংশে খলিফা আছে?
আমার বড় মামা খলিফা। নাম সবুর মিয়া। সবেই ড়াকে সবুর খলিফা।
আমার ঘরে তোমাকে না ঘুমালেও চলবে। আমার শরীর সেরে গেছে।
আমারে আপনের লগে ঘুমাতে বলছে। না ঘুমাইলে পিটন দিবে।
কে পিটন দিবে?
হেড স্যার।
তাহলে ঘুমাও। খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
জ্বে। রাজহাঁসের সালুন দিয়া খাইছি।
রাজহাঁসের সালুন শুনে পেটে আয়েক দফা মোচড় দিচ্ছিল। মিসির আলি সেটা সামলালেন। মাজেদের নাক ডাকার অ্যাওয়াজ পাওয়া যাচেছ। বালিশে মাথা ছোয়ানো মাত্র ঘুমিয়ে পড়ার সৌভাগ্য তারা নেই। তাকে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে। বইপত্র তেমন নিয়ে আসেননি। নিশি যাপন কঠিন হবে।
মিসির আলি ছাত্রের লেখা ডায়েরি হাতে নিলেন। আয়না মেয়েটির বিষয়ে আরো কিছু জানা যাক। আজ সারা দিনে একবারও তার সঙ্গে দেখা হয়নি। মাছের আশিটে গন্ধে কাতর এই মেয়ে কি শুয়ে পড়েছে? না কি সেও নিশি যাপন করছে? মিসির আলি ডায়েরি খুললেন।
আয়নাকে তার বাবা-মা’র কাছে রেখে আমি চলে এলাম। টিচার্সদের মেসে থাকি। ক্লাস নেই। প্রাইভেট টিউশনি করি। কোন কিছুতেই মন বসে না। আমি আয়নাকে একটা মোবাইল টেলিফোন কিনে দিয়েছিলাম। টেলিফোন সে ব্যবহার করে না। আমি যতবার টেলিফোন করি, তার সেন্ট বন্ধ পাই। আয়নাকে প্রতি সপ্তায় একটা করে চিঠি দেই, সে চিঠিরও জবাব দেয় না।
এক মাসের মাথায় আমি কোয়াটার পেয়ে গেলাম। তিনি কামরার ঘর। বারান্দা আছে। দক্ষিণমুখী জানালা। প্রচুর বাতাস। আয়নাকে এখন নিজের কাছে এনে রাখার আর বাধা নেই।
ঘর সাজানোর কিছু আসবাবপত্র কিনলাম। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলনা। হাঁড়ি-পাতিল কিনিলাম না, আয়নাকে সঙ্গে নিয়ে কিনিব। ঘর সাজানোর জিনিসপত্র কিনতে মেয়েরা সব সময় আনন্দ পায়। তবে আয়না আর দশটা মেয়ের মত না। সে আলাদা এবং প্ৰবল ভাবেই আলাদা। সে কি আগ্রহ নিয়ে হাঁড়িকুড়ি কিনতে যাবে?
এক রাতের ঘটনা। আমি রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে এসে ঘুমানোর আয়োজন করছি। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কারেন্ট চলে গেছে। ঘর অন্ধকার। মোমবাতি জ্বলিয়েছি। বাতাসে মোমবাতি নিভু নিভু করছে। আমি দরজা জানালা বন্ধ করে বাতাস আটকালাম, আর তখন মোবাইল টেলিফোন বেজে উঠল।
হ্যালো কে?
আমি আয়না।
কেমন আছ আয়না?
ভাল না।
ভাল না কেন?
জানি না।
আমি তোমাকে অনেকগুলি চিঠি পাঠিয়েছি। তুমি পেয়েছ?
হ্যাঁ।
পড়েছ?
না।
পড়নি কেন?
ভাল লাগে না।
ভাল না লাগলে পড়ার দরকার নেই। এই শোন, আমি কোয়ার্টার পেয়েছি। ছিমছাম সুন্দর বাসা। বড় বারান্দা। দক্ষিণ দিকে বারান্দাতো প্রচুর বাতাস।
তোমার ঘরে কি আয়না আছে?
অবশ্যই আছে। আয়না থাকবে না কেন?
কয়টা আয়না?
তোমার জন্যে একটা ড্রেসিং টেবিল কিনেছি। সেখানে আয়না আছে। বাথরুমে আয়না আছে। আরেকটা যেন কোথায় আছে। ও আচ্ছা, বেসিনের সঙ্গে।
তুমি একটা আয়নার সামনে দাঁড়াওতো।
কেন?
আছে একটা ব্যাপার। আয়নার সামনে দাঁড়াও।
এই বলেই আয়না টেলিফোনের লাইন কেটে দিল।
আমি চেষ্টা করেও তাকে ধরতে পারলাম না। সে মোবাইল সেট বন্ধ করে দিয়েছে। আমি ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। চমকে দেখি আয়নায় আমার স্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে। তার পরনে শাড়ি। ঘোমটা দেয়া। মুখ হাসি হাসি। সে এখন আছে অতি রূপবতী রূপে। তার আশেপাশে কিছুই নেই।
প্রথমে ভাবলাম বিকট চিৎকার দেই। সেই ভাবনা স্থায়ী হল না। বিকট চিৎকার কেন দেব? অয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে আমার স্ত্রী। কেন এ রকম দেখছি তার কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আমার কাছে না থাকলেও ব্যাখ্যা থাকতে হবে।
আমার শিক্ষক মিসির আলি সব সময় বলতেন- সব মানুষই জীবনের কোনও না কোন সময় অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। তখন সে যুক্তির সিঁড়ি থেকে সরে দাঁড়ায়। নিজেকে সমৰ্পণ করে। রহস্যময়তার কাছে। এই কাজটি কখনো করা যাবে না। আমাদের এগুতে হবে যুক্তির কঠিন পথে। মনে রাখতে হবে প্রকৃতি দাঁড়িয়ে আছে যুক্তির উপর। যুক্তি নেই তো প্রকৃতিও নেই।
মিসির আলি স্যার আমার কাছে অতিমানব। তার কথা অবশ্যই অভ্রান্ত। কিন্তু আমি আয়নায় কি দেখছি?
আমি আয়নার ভেতরে আয়না মেয়েটিকে বললাম, তুমি এখানে কি করছ?
আয়না হাসল। মাথা সামান্য কাত করল। আমি বললাম, আমি তোমার ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু বুঝাও।
আয়না না সূচক মাথা নাড়ল।
তুমি আমাকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছি। এটা তুমি করতে পার। You must speak out.
আয়না কথা বলা শুরু করল। সমস্যা একটাই। আমি তার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছি না। তার ঠোঁট নড়ছে। কিন্তু আমি কিছু শুনছি না। ভয়াবহ অবস্থা। আমি মোমবাতি হাতে বাথরুমে আয়নার কাছে গেলাম। সেই আয়নার ভেতরেও আমার স্ত্রী বসে আছে। কথা বলছে কিন্তু আমি কিছুই শুনছি না।