- বইয়ের নামঃ বৃহন্নলা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ প্রতীক প্রকাশনা সংস্খা
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করলেন
অতিপ্রাকৃত গল্পে গল্পের চেয়ে ভূমিকা বড় হয়ে থাকে।
গাছ যত-না বড়, তার ডালপালা তার চেয়েও বড়। এই গল্পেও তাই হবে। একটা দীর্ঘ ভূমিকা দিয়ে শুরু করব। পাঠকদের অনুরোধ করছি তাঁরা যেন ভূমিকাটা পড়েন। এর প্রয়োজন আছে।
আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে।
বাবা-মার একমাত্র ছেলে, দেখতে রাজপুত্র না হলেও বেশ সুপুরুষ। এম এ পাস করেছে। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করা এবং গ্রুপ থিয়েটার করা–এই দুইয়ে তার কর্মকাণ্ড সীমিত।
বাবা-মার একমাত্র ছেলে হলে যা হয়-বিয়ের জন্যে অসংখ্য মেয়ে দেখা হতে লাগল। কাউকেই পছন্দ হয় না। কেউ বেশি লম্বা, কেউ বেশি বেঁটে, কেউ বেশি ফর্সা, কেউ বেশি কথা বলে, আবার কেউ-কেউ দেখা গেল। কম কথা বলে। নানান ফ্যাকড়া।
শেষ পর্যন্ত যাকে পছন্দ হল, সে-মেয়ে ঢাকা ইডেন কলেজে বিএ পড়ে— ইতিহাসে অনার্স মেয়ের বাবা নেই। মার অন্য কোথায় বিয়ে হয়েছে। মেয়ে তার বড়চাচার বাড়িতে মানুষ। তিনিই তাকে খরচপত্র দিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন।
আমার মামা এবং মামী দু জনের কেউই এই বিয়ে সহজভাবে নিতে পারলেন না। যে-মেয়ের বাবা নেই, মা আবার বিয়ে করেছে–পাত্রী হিসেবে সে তেমন কিছু না। তা ছাড়া সে খুব সুন্দরীও না। মোটামুটি ধরনের চেহারা। আমার মামাতো ভাই তবু কেন জানি একবারমাত্র এই মেয়েকে দেখেই বলে দিয়েছে—এই মেয়ে ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। মেয়ের বাবা নেই তো কী হয়েছে? সবার বাবা চিরকাল থাকে নাকি? মেয়ের মার বিয়ে হয়েছে, তাতে অসুবিধাটা কী? অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন, তাঁর তো বিয়ে করাই উচিত; এমন তো না যে, দেশে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ।
মামা-মামীকে শেষ পর্যন্ত মত দিতে হল, তবে খুব খুশিমনে মত দিলেন না, কারণ মেয়ের বড়চাচাকেও তাঁদের খুবই অপছন্দ হয়েছে। লোকটা নাকি অভদ্রের চূড়ান্ত। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। চামার টাইপ।
বিয়ের দিন তারিখ হল।
এক মঙ্গলবার কাকড়াকা ভোরে আমরা একটা মাইক্রোবাস এবং সাদা রঙের টয়োটায় করে রওনা হলাম। গন্তব্য ঢাকা থেকে নব্বই মাইল দূরের এক মফস্বল শহর। মফস্বল শহরের নামটা আমি বলতে চাচ্ছি না। গল্পের জন্যে সেই নাম জানার প্রয়োজনও নেই।
তেত্রিশ জন বরযাত্রী। অধিকাংশই ছেলেছোকরা। হৈচৈয়ের চূড়ান্ত হচ্ছে। এই মাইক বাজছে, এই মাইক্রোবাসের ভেতর ব্রেক ডান্স হচ্ছে, এই পটকা ফুটছে। ফাঁকা রাস্তায় এসে মাইক্রোবাসের গিয়ারবক্সে কী যেন হল। একটু পরপর বাস থেমে যায়। সবাইকে নেমে ঠেলতে হয়। বরযাত্রীদের উৎসাহ তাতে যেন আরো বাড়ল। শুধু আমার মামা অসম্ভব গম্ভীর হয়ে পড়লেন। আমাকে ফিসফিস করে বললেন, এটা হচ্ছে অলক্ষণ। খুবই অলক্ষণ। রওনা হবার সময় একটা খালি জগ দেখেছি, তখনি মনে হয়েছে একটা কিছু হবে। গিয়ারবক্স গেছে, এখন দেখবি চাকা পাংচার হবে। না হয়েই পারে না।
হলও তাই একটা কালভার্ট পার হবার সময় চাকার হাওয়া চলে গেল। মামা বললেন, কি, দেখলি? বিশ্বাস হল আমার কথা? এখন বসে-বসে আঙুল চোষ।
স্পেয়ার চাকা লাগাতেও অনেক সময় লাগল। মামা ছাড়া অন্য কাউকে বিচলিত হতে দেখলাম না।
বরযাত্রীদের উৎসাহ মনে হল আরো বেড়েছে। চিৎকার হৈচৈ হচ্ছে! একজন গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। শুধুমাত্র বিয়েবাড়িতে পৌঁছানোর পরই সবার উৎসাহে খানিকটা ভাটা পড়ল।
মফস্বল শহরের বড় বাড়িগুলি সাধারণত যে-রকম হয়, সে-রকম একটা পুরনো ধরনের বাড়ি। এইসব বাড়িগুলি এমনিতেই খানিকটা বিষগ্ন প্রকৃতির হয়। এই বাড়ি দেখে মনে হল বিরাট একটা শোকের বাড়ি। খা-খী করছে চারদিক। লোকজন নেই। কলাগাছ দিয়ে একটা গেটের মতো করা হয়েছে, সেটাকে গেট না-বলে গেটের প্ৰহসন বলাই ভালো। একদিকে রঙিন কাগজের চেইন, অন্য দিকে খালি{ হয় রঙিন কাগজ কম পড়েছে, কিংবা লোকজনের গোট প্রসঙ্গে উৎসাহ শেষ হয়ে গেছে। আমার মামা হতভম্ব। বরযাত্রীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ব্যাপারটা কি?
হাফশার্ট-পরা এক চ্যাংড়া ছেলে এসে বলল, আপনারা বসেন। বিশ্রাম করেন।
আমি বললাম, আর লোকজন কোথায়?
মেয়ের বড়চাচা কোথায়? সেই ছেলে শুকনো গলায় বলল, আছে, সবাই আছে। আপনারা বিশ্ৰাম করেন।
আমি বললাম, কোনো সমস্যা হয়েছে?
সেই ছেলে ফ্যাকাসে হাসি হেসে বলল, জ্বি-না, সমস্যা কিসের? এই বলেই সে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। আর বেরুল না!
বসার ঘরে চাদর পেতে বরযাত্রীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা। বারান্দায় গোটা দশেক ফোন্ডিং চেয়ার। বিয়েবাড়ির সজ্জা বলতে এইটুকুই।
মামা বললেন, বলেছিলাম না। অলক্ষণ? এখন বিশ্বাস হল? কী কাণ্ড হয়েছে কে জানে। আমার তো মনে হয় বাড়িতে মেয়েই নেই। কারের সঙ্গে পালিয়েটালিয়ে গেছে। মুখে জুতোর বাড়ি পড়ল, স্রেফ জুতোর বাড়ি।
মামা অল্পতেই উত্তেজিত হন। গত বছর তাঁর ছোটখাটো ক্টোক হয়ে গেছে। উত্তেজনার ব্যাপারগুলি তাঁর জন্যে ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমি মামাকে সামলাতে চেষ্টা করলাম। হাসিমুখে বললাম, হাত-মুখ ধুয়ে একটু শুয়ে থাকুন তো মামা। আমি খোঁজ নিচ্ছি কী ব্যাপার।
মামা তীব্র গলায় বললেন, হাত-মুখটা ধোব কী দিয়ে, শুনি? হাত-মুখ ধোবার পানি কেউ দিয়েছে? বুঝতে পারছিস না? এরা বেইজ্জতির চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছে।