- বইয়ের নামঃ মিসির আলি আপনি কোথায়
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
মিসির আলি কুয়াশা দেখছেন
০১.
মিসির আলি অবাক হয়ে কুয়াশা দেখছেন।
কুয়াশা দেখে অবাক বা বিস্মিত হওয়া যায় না। তিনি হচ্ছেন। কারণ কুয়াশা এক জায়গায় স্থির হয়ে নেই। সে জায়গা বদল করছে। তার সামনে মাঝারি সাইজের আমগাছ। কুয়াশায় গাছ ঢাকা। ডালপালা পাতা কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ কুয়াশা সরে গেল। আমগাছ দেখা গেল। সেই কুয়াশাই ভর করল পাশের একটা গাছকে, যে গাছ তিনি চেনেন না।
বাতাস কুয়াশা সরিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিচ্ছে এই যুক্তি মেনে নেয়া যাচ্ছে না। বাতাস বইলে তিনি টের পেতেন শীতের বাতাস শরীরে কাঁপন ধরায়।
এই কুয়াশার ইংরেজি কি Fog নাকি Mist? শহরের কুয়াশা এবং গ্রামের কুয়াশা কি আলাদা? শহরের ধূলি ময়লার গায়ে চেপে যে কুয়াশা নামে তাকে কি বলে Smog?
মিসির আলি বেতের মোড়ায় চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছেন। তাঁর পায়ে উলের মোজা। শিশিৱে মোজা ভিজে যাচ্ছে। হাতে Louis Untermeyer নামের এক ভদ্রলোকের বই নাম Poems. বইয়ের পাতাও শিশিরে ভিজে উঠছে। তিনি কইলাটি নামের এক গণ্ডগ্রামে গত দুদিন ধরে বাস করছেন। এখন বসে আছেন দোতলা এক হলুদ রঙের পাকা বাড়ির সামনে। বাড়ি কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সূৰ্য উঠলে প্রথমেই তাঁর গায়ে রোদ পড়বে। সূৰ্য উঠছে না।
তাঁর চা খেতে ইচ্ছে করছে, তাঁকে চা দেয়া হচ্ছে না। তাঁর জন্য খেজুরের রস আনতে লোক গিয়েছে। কইলাটি হাইস্কুলের হেডমাস্টার তরিকুল ইসলাম এমএ বিটি বলেছেন-খেজুরের রস এক গ্লাস খাবার পর চা দেয়া হবে। তার আগে না। খেজুরের রস নাকি খালি পেটে খেতে হয়।
তরিকুল ইসলাম এই মুহূর্তে মিসির আলির আশপাশে নেই। বাড়িতে ভাপাপিঠা রান্না হচ্ছে। তিনি পিঠার খবরদারি করছেন। পিঠা জোড়া লাগছে না। ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। এই নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে রাগারগি করছেন। গতকাল দুধপিঠা হয়েছিল। দুধ কী কারণে ছানা ছানা হয়ে গেল, মেহমানের সামনে বেইজ্জাতি ব্যাপার। ঢাকার মেহমানকে একদিনও ভালো মতো পিঠা খাওয়ানো যায় নি, এরচে দুঃখের ব্যাপার কী হতে পারে?
গ্রামের মানুষদের মধ্যে সবচে বেশি কথা বলে নাপিতরা। তারপরেই স্কুল শিক্ষকরা। তরিকুল ইসলাম কথা বলায় শিক্ষকদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন। তিনি সারাক্ষণই কথা বলেন। কেউ তার কথা শুনিছে কি শুনছে না, তা নিয়ে মাথা ঘামান না। এখন তিনি কথা বলে যাচ্ছেন স্ত্রীর সঙ্গে। তার স্ত্রী সালেহা মাথায় ঘোমটা দিয়ে পিঠা বানাচ্ছেন। তিনি চুলার আগুনের পাশে হাত মেলে কথার তুফান মেইল চালাচ্ছেন–
সালেহা! তুমি বাংলাদেশের গ্রামের একজন সিনিয়ার মহিলা। তুমি পিঠা বানাতে পার না এটা কত বড় দুঃখের কথা তা কি জান? এটা হল ক্লাস থ্রির পরীক্ষায় ফেল করার মতো। শহরের একজন বিশিষ্ট মেহমান তাকে আমি পিঠা খাওয়াতে পারব না? কী আপশোস! আরেক হারামজাদাকে খেজুরের রস আনতে পাঠালাম তার খোজ নাই। সে মনে হয় খেজুরগাছে চড়ে বসে আছে। কাঁটার ভয়ে নামতে পাবছে না। এদের সকল বিকাল থাপড়ানো দরকার। বদমাইশের ঝাড়। কামের মধ্যে নাই, আকামে আছে।”
মিসির আলি হতাশ চোখে তাঁর হাতের জাম্বো সাইজের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত বড় গ্লাস যে এখনো বাংলাদেশে আছে তা তিনি জানতেন না। পুরো এক জগা পানি এই গ্লাসে ধরবে তারপরেও গ্লাস ভরবে না, এ বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।
তরিকুল ইসলাম বললেন, এক চুমুকে খান। অতি সুস্বাদু। অমৃত সম।। ফুঁ দিয়ে ফেনা সরান, তারপর চুমুক দেন। অবিশ্যি ফেনারও আলাদা স্বাদ আছে।
মিসির আলি ফুঁ দিয়ে ফেনা সরিয়ে চুমুক দিলেন। তাঁর শরীর গুলিয়ে উঠল। অতিরিক্ত মিষ্টি। বাসি ফুলের গন্ধের মতো গন্ধ। গ্লাসে দ্বিতীয় চুমুক দেবার প্রশ্নই ওঠে না।
তরিকুল ইসলাম হাসিমুখে বললেন, খেতে কেমন বলুন। অমৃত না? রস আগুনে জ্বাল দিয়ে ঘন করে বিকেলে এক প্লাস দেব। দেখবেন কী অবস্থা। খেজুর গুড়ের গন্ধ ছাড়বে, মোহিত হয়ে যাবেন। গ্লাস নিয়ে বসে আছেন কেন, চুমুক দিন।
মিসির আলি দ্বিতীয় চুমুক দিলেন। এই বস্তু যে তাঁর পক্ষে খাওয়া সম্ভব না, তা তিনি কীভাবে বলবেন বুঝতে পারছেন না। ‘না’ বলতে পারা মস্ত বড় গুণ। মিসির আলি এই গুণ থেকে বঞ্চিত। তিনি কারোর মুখের উপরই না বলতে পারেন।
তরিকুল ইসলাম বললেন, রসটা এক চুমুকে নামিয়ে দেন। আমি চা নিয়ে আসছি। গরম গরম চা খান। ঠাণ্ডার পর গরম চার তুলনা হয় না। নাশতা দিতে একটু দেরি হবে। পিঠা তৈরিতে সামান্য সমস্যা হচ্ছে। যাই চা নিয়ে আসছি।
মিসির আলি ভদ্ৰলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন। কুয়াশার ভেতর মানুষটা অদৃশ্য হওয়া মাত্র মিসির আলি হাতেীয় গ্লাসের রস উলটে দিলেন। তার ঢাকায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। ছায়া ঢাকা ঘুঘু ডাকা গ্রাম তেমন পছন্দ হচ্ছে না। শহরবাসী হওয়ার এই এক সমস্যা। ভোরবেলা চায়ের কাপের সঙ্গে পত্রিকা লাগে। ভালো বাথরুম লাগে। রাতে বই পড়ার জন্য টেবিল ল্যাম্পের আলো লাগে।
তরিকুল ইসলামের গ্রামের বাড়িতে শহরের অনেক সুযোগ-সুবিধাই আছে। আধুনিক ধাঁচের দোতলা পাকা বাড়ি। পল্লীবিদ্যুৎ না থাকলেও সোলার প্যানেলে ইলেকট্রসিটি তৈরি হয়। সেই ইলেকট্রসিটিতে পাখা চলে, বাতি জ্বলে এবং টিভি চলে। এমন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সোলার এনার্জি দেখে মিসির আলি অবাক হয়েছিলেন। তরিকুল ইসলামের কথায় অবাক ভাব দূর হল।