আমি বললাম, আচ্ছা।
আমাদের এই বারান্দা থেকে নদী দেখা যায়। নদীর নামটা সুন্দর। তোমাকে কি কেউ নদীটির নাম বলেছে?
আমি বললাম, বলেছিল। এখন ভুলে গেছি।
নদীর নাম রায়না।
আমি বললাম, ও আচ্ছা রায়না।
কুলসুম বলল, রায়না’র সঙ্গে কিসের মিল বলতো।
আমি বললাম, জানি না।
কুলসুম বলল, আয়না। রায়না আয়না। আমার ডাক নাম কিন্তু অয়না।
তাই না-কি?
হুঁ।
আমি প্ৰায় অপলকেই তাকিয়ে আছি আয়না নামের মেয়েটির দিকে। সে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে। কথা শুনছি। বার বার মনে হচ্ছে এই মেয়েটির প্রতিটি কথার অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যা ধরতে পারছি না। মাথার ভেতর আয়না এবং রায়না ঘুরপাক খাচ্ছে–
নদীর নাম রায়না
সেই নদীতে সিনান করে।
অবাক মেয়ে আয়না।
আমি অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছি। ছড়া কবিতা এইসব কখনো আমার মাথায় আসে না। তাহলে ছড়া তৈরি করছি কেন? সমস্যাটা কি।
আয়না। হাসিমুখে বলল, দেখ দেখ বৃষ্টি নেমেছে।
ঘরের পর্দা কাঁপছে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। জানালার লাগোয়া কদমগাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দ। আয়না বলল, চল বারান্দায় বসি। সে এসে হাত ধরে আমাকে দাঁড় করাল। আমার ঘোর আরো প্রবল হলো।
বারান্দা অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। তার নীল আলোয় চারদিক স্পষ্ট হয়ে আবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা দু’জন পাশাপাশি দুটা বেতের চেয়ারে বসে আছি। আমার রীতিমত শীত লাগছে। আয়না একটা চাদর এনে আমার গায়ে দিয়েছে। বাইরে ঠাণ্ডা। চাদরের নিচে আরামদায়ক উষ্ণতা। আয়না বলল, তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?
হুঁ।
আয়না বলল, ঘুম পেলে ঘুমাও। সারাদিন নানান ধকল গেছে। তুমি ক্লান্ত হয়ে আছ। ঘুম পাবারই কথা। তুমি আরাম করে ঘুমাও তো। রেস্ট নাও। আমি ডেকে দেব।
আচ্ছা।
আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। আমার ঘুম ভাঙলো পরদিন ভোরে। আয়না আমাকে ডেকে তুলল। তার হাতে চায়ের কাপ। আমি প্ৰচণ্ড ধাক্কা খেলাম। কারণ আমার সামনে যে আয়না দাঁড়িয়ে আছে সে রাতের আয়না না। সাধারণ বাঙালি এক তরুণী। গায়ের রং শ্যামলা। বেঁচো নাক। আমি প্ৰচণ্ড দ্বিধার মধ্যে পড়লাম। গত রাতে যে আয়নাকে দেখেছি, সে সত্যি না এখন যে আয়না আমার সামনে দাড়িয়ে আছে সে সত্যি? আমি কি কোনো মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি? সিজিওফ্রেনিক রোগীর মতো হেলুসিনেশন হচ্ছে?
আয়না বলল, তুমি পানি দিয়ে কুলি করে চা খাবে না-কি বাসিমুখে চ্য খাবে?
আমি জবাব দিলাম না। আয়নার হাত থেকে চায়ের কাপ নিলাম। আয়না বলল, ঠিক আছে বাসি মুখেই চা খাও। তারপর হাত মুখ ধুয়ে নিচে যাও। বাবা নাশতা নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। বেলা। কিন্তু অনেক হয়েছে। সাড়ে ন’টা বাজে।
নাসতার টেবিলে আয়নার বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে না-কি?
খারাপ করেছে না-কি?
আমি বললাম, না।
রাতে ভালো গরম পড়েছিল। গরমে মনে হয়।ঘুমাতে পার নাই।
আমি বললাম, বৃষ্টি নামার পর সব ঠাণ্ডা। আরাম করে ঘুমিয়েছি।
উনি অবাক হয়ে বললেন, বৃষ্টি মানে? বৃষ্টি হয় নাই তো।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বৃষ্টি হয় নাই?
তিনি আমার শাশুড়িকে ডেকে বললেন, জামাই কি বলছে শোন। কাল রাতে না-কি বৃষ্টি হয়েছে।
আমার শাশুড়ি বললেন, ‘হপন’ দেখেছে।
এই পর্যন্ত পড়ে মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন।
গ্রামের মেয়েটির স্নান শেষ হয়েছে। সে চলে গেছে। মাছরাঙা পাখি ফিরে এসেছে। সে বসেছে ঠিক আগের জায়গায়। ডাইনিং টেবিলে কে কোন চেয়ারে বসবে সেটা যেমন ঠিক করা থাকে পাখিদের ক্ষেত্রেও হয়ত তাই। আমি বসব এই খুঁটিতে তুমি বসবে ঐটায়।
মিসির আলি সাহেব! আপনি এইখানে। আপনার সন্ধানে সমস্ত অঞ্চল চয়ে ফেলেছি। মাইকে ঘোষণা দিব কি-না চিন্তায় আছি আর আপনি এইখানে বসা। বটগাছ হলো সাপের আড্ডা। চলে আসেন। চলে আসেন।
তরিকুল ইসলাম উদ্বিগ্ন গলার স্বর বের করলেন। মিসির আলি বললেন, শীতকালে সাপ থাকে না। সব হাইবারনেশানে চলে যায়। শীত নিদ্ৰা।
তরিকুল ইসলাম বললেন, পুরানা নিয়ম-কানুন। এখন নাই। অনেক সাপ আছে শীতকালেও জেগে থাকে। আসেন তো ভাই। চিতল মাছ চলে এসেছে। আপনাকে না দেখায়ে কাটতেও পারছি না। চিতল মাছ রাঁধতে সময় লাগে না। কিন্তু কাটাকুটি বিরাট হাঙ্গামা। বটগাছের গুড়িতে বসে করছিলেন কি?
দৃশ্য দেখছিলাম।
দৃশ্য দেখার কি আছে। এখানে। কিছুই নাই। আধমরা এক নদী। নদীর পাড় ঘেঁষে যে হাঁটবেন। সেই উপায় নাই। সবাই নদীর পাড়ে হাগে। গ্রামের মানুষদের এমনই মেন্টালিটি-বাড়িতে সেনিটারি পায়খানা করে দিলেও হাগতে আসবে নদীর পাড়ে।
মিসির আলি বললেন, এই প্রসঙ্গটা থাক। আসুন অন্য কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করি।
কি প্রসঙ্গ?
আপনার জামাইকে নিয়ে কথা বলুন! বাড়িতে যেতে যেতে আপনার জামাইয়ের কথা শুনি। সে কেমন ছেলে?
ভালো। শুধু ভালো বললে কম বলা হবে অত্যাধিক ভালো। আয়নার সঙ্গে তার বনিব্যুনা হয় নাই। তারপরেও সে সব সময় আমার খোঁজ খবর করে। গত ঈদে আমাকে সিল্কের পাঞ্জাবি দিয়েছে। তার শাশুড়ির জন্যে লাল পেড়ে কাতান শাড়ি।
ভালো তো।
আমের সিজনে দুই ঝুড়ি আমি আনবেই। রাজশাহীর আমি। এক ঝড়ি খিরসাপাতি আরেক ঝুড়ি ল্যাংড়া।
আয়নার সঙ্গে বনিবিনা হলো না কেন?
ছেলের কোনো দোষ নাই। মেয়েটির সমস্যা। মাথা খারাপ মেয়ে। কোনো কারণ ছাড়া দুই দিন তিন দিন দরজা বন্ধ করে বসে থাকে।