চমৎকার কোনো জায়গায় বসে ডায়েরি পড়া যায় না। ডায়েরি বা গল্পের বই পড়ার অর্থ প্রসারিত দৃষ্টিকে গুটিয়ে নিয়ে আসা। ডায়েরি পড়ার চেয়ে মিসির আলি অনেক বেশি আগ্ৰহবোধ করছেন মাছরাঙা পাখিটার গতিবিধি লক্ষ করায়। এর নাম মাছরাঙা কেন হলো। মাছ খেয়ে সে রাঙা হয়েছে এই জন্যে? তাহলে তো বকের নাম হওয়া উচিত মাছ সাদা। কারণ মাছ খেয়েই সে ধবধবে সাদা হয়েছে।
মিসির আলির চিন্তায় বাধা পড়ল। দুটি মাছরাঙাই হঠাৎ উড়ে গেছে। তাদের উড়ে যাওয়ার পেছনেও ব্যাখ্যা আছে। গ্রামের এক তরুণী মেয়ে নদীতে স্নান করতে এসেছে। সে হয়তো ভেবেছে আশেপাশে তাকে লক্ষ করার মতো কেউ নেই। অর্ধনগ্ন হওয়া যেতে পারে। মিসির আলি খাতা খুলে চোখ সরিয়ে নিলেন। মেয়েটির স্নান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার ছাত্রের লেখা পড়া একটি শোভন কর্ম।
আমার বিয়ে হয় তেইশে শ্রাবণ। ইংরেজি তারিখটা মনে থাকে না। বাংলাটা মনে থাকে কারণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের দিনটাই আমার বিয়ের তারিখ।
স্ত্রীর নাম কুলসুম। বিয়ের আগে আমি তাকে দেখিনি। দেখার তেমন কৌতূহলও বোধ করি নি। আমার দূর সম্পর্কের এক মামা বিয়ে ঠিক করে দেন। গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের মেয়ে। বিএ পাস করেছে। বিএ’তে ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছে। মেয়েটির এই যোগ্যতাই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। গ্রামের এক কলেজ থেকে ফাস্ট ডিভিশন পেয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়া সহজ কথা না। মামা মেয়েটির ছবি দেখিয়েছেন। মেয়েটি সুশ্ৰী। বেঁচো নাক তবে তাতে খারাপ দেখাচ্ছিল না। মামা বললেন, মেয়েটির গাত্ৰবৰ্ণ উজ্জ্বল শ্যামলা। আমি ধরেই নিলাম মেয়ে কালো। বিয়ের পাত্রীর গায়ের রঙ কালো হলে তাকে উজ্জ্বল শ্যামলা ঘলাটাই শিষ্টাচার।
আমি আমার হবু স্ত্রীর গায়ের রঙ বা চেহারা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। তার প্রধান কারণ পাত্র হিসেবে আমি নিচের দিকে। আবার বাবা-মা নেই। বাড়িঘর নেই। চাকরিটাই সম্বল। বাংলাদেশের কোনো বাবা-মা এতিম ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে আগ্রহী না। তার চান মেয়ে যেন থাকে শ্বশুর-শাশুড়ির আদরে ও প্রশ্ৰয়ে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে রকম ঘটে না।
তোইশে শ্রাবণ সোমবার সন্ধ্যায় আমার বিয়ে হলো। ঠিক হলো মেয়ে বাবার বাড়িতেই থাকবে। কলেজ থেকে কোয়ার্টার পাওয়ার পর মেয়ে উঠিয়ে নেয়া হবে।
বাসরের আয়োজন হলো মেয়ের বাবার বাড়িতে। বাড়িটা সুন্দর। দোতলা পাকা দালান। যে ঘরে বাসর সাজানো হলো সে ঘরটা বেশ বড়। পাশে রেলিং দেয়া বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়ালে নদী দেখা যায়। নদীর নাম রায়না।
বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ার পর কিছু মেয়েলি আচার আছে। একই গ্লাসে সরবত খাওয়া। আয়নায় মুখ দেখা ইত্যাদি। সব আচারই পালন করা হলো শুধু আয়নায় মুখ দেখার অংশটা বাদ গেল। আমাকে জানানো হলো- মেয়ে আয়নায় মুখ দেখবে না। কারণ সে খুব আয়না ভয় পায়। আমার সামান্য খটকা লাগিল। মেয়ে আয়না ভয় পাবে কেন? সে সিজিওফ্রেনিক না তো? কিছু সিজিওফ্রেনিক নিজের মুখোমুখি হতে ভয় পায় বলে আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারে না। তাদের মনোবিশ্লেষণের একটা পর্যায়ে বড় বড় আয়নার সামনে দাঁড় করানো হয়। নিজের মুখোমুখি হওয়াতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়। এই বিষয়ে আমার শিক্ষক মিসির আলি সাহেবের একটি পেপার আছে। নাম Mind Mirror game.
কুলসুমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো বাসর রাতে। আমার এক বৃদ্ধ নানীশাশুড়ি তাকে নিয়ে এলেন। গ্রামের বৃদ্ধারা অশ্লীল কথা বলতে পছন্দ করে। এই বৃদ্ধাও তার ব্যতিক্রম না। তিনি ধাক্কা দিয়ে কুলসুমকে আমার গায়ে ফেলে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, জামাই! জিনিস দিয়া গেলাম। শাড়ি, ব্লাউজ খুঁইল্যা দেইখা নেও সব ঠিক ঠিক আছে কি-না। এই বাক্যটির পর তিনি আরো একটি কুৎসিত বাক্য বললেন। সেই বাক্যটি লেখা সম্ভব না। ঘেন্নায় আমার শরীর প্রায় জমে গেল। আমি আমার স্ত্রীর দিকে লজ্জায় তাকাতেও পারছিলাম না। না জানি মেয়েটা কি মনে করছে। নানীশাশুড়ি ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র কুলসুম। মাথার ঘোমটা সরিয়ে স্পষ্ট এবং শুদ্ধ ভাষায় বলল, তুমি নানীজনের কথায় কিছু মনে করো না। গ্রামের এক বৃদ্ধার কাছ থেকে সুরুচি আশা করা যায় না।
আমি হতভম্ব হয়ে কুলসুমের দিকে তাকালাম। হতভম্ব হবার প্রধান কারণ— আমি আমার সমগ্র জীবনে এত রূপবতী মেয়ে দেখিনি। নিখুঁত সৌন্দৰ্য সম্ভবত একেই বলে। হেলেন অব ট্রয়, কুইন আব সেবা, ক্লিওপট্রা এরা কেউ এই মেয়েটির চেয়েও সুন্দর তা হতেই পারে না। আমি নিজের অজান্তেই বললাম, Oh my God. কি দেখছি।
কুলসুম বলল, আমাকে দেখছি। আর কি দেখবে?
আমি এখন খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে কুলসুমকে দেখছি। কোনো হিসাবই মিলছে না। গ্রামে বড় হওয়া একটা মেয়ে আগ বাড়িয়ে বিয়ের রাতে স্বামীর সঙ্গে তুমি তুমি বলে কথা বলা শুরু করবে না। চোখে চোখ রেখে স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকবে না। সারাক্ষণ জড়সড় হয়ে থাকার কথা। আমার চিন্তা-ভাবনা সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। কি বলব বুঝতে পারলাম না।
কুলসুম বলল, তোমার গরম লাগছে না?
আমি তখন প্ৰবল ঘোরে। গরম-শীতের কোনো অনুভূতি নেই। তারপরেও বললাম, হুঁ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বুম বৃষ্টি নামবে। এমন ঠাণ্ডা লাগবে যে রীতিমত শীত করবে।
আমি বললাম, হুঁ।
কুলসুম বলল, বৃষ্টি নামলে আমরা বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখব।