নদীর নাম রায়না।
সে কোথাও যায় না।
সমুদ্রকে পায় না।
মিসির আলি নড়েচড়ে বসলেন। তার মাথায় ছড়া পাঠ হচ্ছে। পাঠ করছে আয়না নামের মেয়েটি। এর মানে কী? জীবনে প্রথম মিসির আলি হতাশ এবং পরাজিত বোধ করলেন।
The old man and the sea বইটিতে আৰ্নেস্ট হেমিংওয়ে একটা বিখ্যাত লাইন লিখেছিলেন Man can be destroyed but not defeated. লাইনটা ভুল। মানুষকে অসংখ্যাবার পরাজিত হতে হয়। এটাই মানুষের নিয়তি। পরাজিত হয় না পশুরা। এটাও বোধ হয় ঠিক না। পশুরাও পরাজিত হয়। সিংহ এবং বাঘের যুদ্ধে একজনকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়।
স্যার, আপনার চা। সিগারেট।
আয়না চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল। মিসির আলি বললেন, আয়না তুমি এখন যাও। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব।
আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
না।
আপনার ছাত্র সব সময় বলত আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষ সে জীবনে দেখে নি। আপনাকে আমার দেখার শখ ছিল।
স্বায়ন পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব। এখন না।
স্যার, চা শেষ করে আপনি নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটতে যান, আপনার ভালো লাগবে। একটা পুরোনো বটগাছ আছে। সেখানে বসার জায়গা আছে। আমি ফ্রাস্ক ভর্তি কয়ে চা দিয়ে দেব।
থ্যাংক য়্যু। এখন যাও।
স্যার, যাচ্ছি। একটা কথা বলে যাই? পরাজিত হবার মধ্যেও কিন্তু আনন্দ আছে স্যার!
পরাজয়ের আবার আনন্দ কী?
অবশ্যই পরাজয়ের আলাদা আনন্দ আছে। আনন্দ আছে বলেই প্রকৃতি আমাদের জন্য পরাজয়ের ব্যবস্থা রেখেছে। মৃত্যু একটা পরাজয়। সেখানেও আনন্দ আছে। সমাপ্তির আনন্দ।
তুমি পড়াশোনা কতদূর করেছ?
বিএ পাস করেছি। আপনার ছাত্রের খুব ইচ্ছা ছিল আমি এমএ পাস করি। আমার ইচ্ছা হয় নি। স্যার যাই? আপনি সিগারেট ঠোঁটে নিন। আমি ধরিয়ে দেব।
মিসির আলি সিগারেট নিলেন। আয়না ধরিয়ে দিল। আয়নার চোখ আনন্দে ঝলমল করছে।
হলুদ রঙের লম্বা লেজের পাখিটা বারান্দার রেলিংয়ে বসেছে। রেলিংয়ে পাখিটা বসানোর পেছনে কি আয়না মেয়েটার কোনো হাত আছে? কাক এবং চড়ুই ছাড়া আর কোনো পাখি তো মানুষের এত কাছে আসে না। বনের এই অচেনা পাখি এত কাছে এসেছে কেন?
আয়না।
জি স্যার।
এখন কী ভাবছি বল। আয়না কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বলতে পারছি না স্যার। খুবই অবাক হচ্ছি।
মিসির আলি বললেন, তুমি যাতে আমার মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে না পার, তার একটা কৌশল বের করেছি। কৌশলটি কাজ করেছে।
আয়না বলল, কৌশলটা কী?
মিসির আলি বললেন, কৌশল তোমাকে জানানো ঠিক না। তারপরেও জানাচ্ছি। আমার হাতের কবিতার বইটার নাম উল্টো করে স্বাক্সবার পড়ছিলাম-বইটার নাম Poems. আমি উল্টো করে পড়ছি Smeop, Smeop.
ব্ৰেইনে অর্থহীন শব্দ ধারবার বলে জট পাকিয়েছি। মনে হয় এটাই কাজ করেছে।
মিসির আলি বটগাছের গুড়িতে
মিসির আলি বটগাছের গুড়িতে বসে আছেন। বসার জন্যে জায়গাটা সুন্দর। অর্ধেক বটগাছ রায়না নদীর উপর। নদীর পানি শিকড়ের মাটির অনেকটাই ধুয়ে নিয়ে গেছে। অসহায় বটবৃক্ষ নিজেকে রক্ষার জন্যে অসংখ্য ঝুরি নামিয়েছে। সে এখনো টিকে আছে। কতদিন টিকবে কে জানে।
প্ৰথমবারের মতো মিসির আলির মনে হলো তার একটা ক্যামেরা থাকলে ভালো হতো। নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছের ছবি তুলে রাখতেন। ভাতের থালা হাতে নিরন্ন ভিখিরি ছেলের ছবি তুলতে ফটোগ্রাফাররা পছন্দ করেন। এই বিশাল গাছও এক অর্থে ভিক্ষুক। সে বেঁচে থাকার জন্যে করুণা ভিক্ষা করছে নদীর কাছে। যে নদীর নাম রায়না। মিসির আলি আরাম করে বসেছেন। পায়ের নিচের পানির ছলাৎ শব্দ শুনতে ভাল লাগছে। নদীর পানি যদিও সবসময় একই গতিতে বইছে কিন্তু ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা থেমে থেমে হচ্ছে। কিছুক্ষণ ছলাৎ ছলাৎ তারপর আর শব্দ নেই কঠিন নীরবতা। এর কারণ কি? আমাদের চারপাশে অমীমাংসিত সব রহস্য।
নদীর নামটাও তো রহস্যের একটা। কে দিয়েছে রায়না নাম? প্রাচীন পৃথিবীতে মানবগোষ্ঠী খণ্ড খণ্ড ভাগ হয়ে নদীর পাশে বসতি করেছে। হঠাৎ কেউ একজন কি সেই নদীকে ব্ৰহ্মপুত্ৰ নাম দিয়ে দিল। বিশাল এলাকা জুড়ে নদী। সবাই তাকে ডাকছে ব্ৰহ্মপুত্ৰ নামে। কারণ কি? বটগাছের কথাই ধরা যাক। কে তার প্রথম নাম দিল? সেই নাম কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল? এমন তো না কিছু জায়গায় নাম বটবৃক্ষ আবার কিছু জায়গায় হুটবৃক্ষ।
মিসির আলির মাথায় এলোমেলো চিন্তা একের পর এক আসছে। তার ভালোই লাগছে। নামকরণ রহস্যের সমাধান তাকে করতে হবে না। এই দায়িত্ব তাকে কেউ দেয় নি। রহস্যের প্রতি সামান্য কৌতূহল প্রদর্শন করলেই হবে।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। তাঁর দৃষ্টি এখন পাখিদের কর্মকাণ্ডে। পাখিদের বড় অংশই বিক। তারা মাছ ধরায় ব্যস্ত। দুটা মাছরাঙা দেখা যাচ্ছে। মাছরাঙার প্রধান খাদ্য মাছ। তবে তারা মাছ ধরায় আগ্রহী না। তারা বাঁশের খুঁটিতে পাশাপাশি বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর একজন আরেক জলকে দেখছে। মাছরাঙা যে এত সুন্দর পাখি তা আগে তিনি লক্ষ করেন নি। ক্যামেরা থাকলে অবশ্যি মাছরাঙার ছবি তুলতেন।
জায়গাটা নিৰ্জন। নদীর পাড় ধরে লোক চলাচল নেই বললেই হয়। নদীতে অনেকক্ষণ পর পর নৌকার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। সবই ইনজিনের নৌকা। দ্রুত বিদায় হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম-বাংলার শ্লথ জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে।
মিসির আলি চায়ের ফ্লাক্স বের করার জন্যে কাপড়ের ঝুলি খুললেন। আয়না মেয়েটা শুধু যে ফ্ল্যাক্স ভর্তি চা দিয়েছে তা-না এক প্যাকেট বিসকিট দিয়েছে। বিসকিটের নাম Energy. সাদা কাগজ এবং বল পয়েন্ট দিয়েছে। সে কি ভেবেছে মিসির আলি লেখক মানুষ? র্যাক্সিনে বাঁধানো একটা ডায়েরিও দেখা যাচ্ছে। মিসির আলি কৌতূহলী হয়ে ডায়েরি খুললেন। যা সন্দেহ করেছিলেন। তাই। তার ছাত্রের লেখা ডায়েরি। সে তার স্ত্রী আয়না সম্পর্কে লিখেছে।