তরিকুল ইসলাম বললেন, তোর জামাইয়ের শিক্ষক। কদমবুসি কর।
আয়না স্পষ্ট গলায় বলল, একবার কদমবুসি করেছি। বাবা। সকালে স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আর তোমরা স্যারকে এক গাদা পিঠা দিয়ে বসিয়ে রেখেছি কেন? স্যার নাশাতায় মিষ্টি খেতে পারেন না। মাংস পরোটা দাও। এখন থেকে স্যারের খাবারদাবারের সব দায়িত্ব আমার।
আয়না পরোটা এবং মাংসের বাটি নিয়ে মিসির আলির সামনে দাঁড়াল। মিসির আলি আচমকা ধাক্কার মতো খেলেন। ভোরবেলায় দেখা সেই মেয়ে। গায়ের রূপ জোছনার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বড় বড় কালো চোখ। সেই চোখে পাপড়ির ছায়া। অভিমানী পাতলা ঠোঁট। মিসির আলি চোখ নামিয়ে নিলেন। দীর্ঘ সময় ভ্রান্তির দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না।
সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি কি রক্ত মাংসের মানুষ?
নাকি মায়া?
বাস্তব জগতের পুরোটাই মায়া। একটাই সমস্যা মায়া ধরার কোনো পথ নেই। আইনষ্টাইনের কথা। অতি বাস্তববাদী বিজ্ঞানীর পরাবাস্তব উক্তি।
আয়না বলল, স্যার পরোটা দেই?
মিসির আলি বললেন, দাও।
তরিকুল ইসলাম বললেন, তোর স্যার বলছিলেন তোর মতো রূপসী মেয়ে তিনি নাকি দেখেন নাই।
আয়না বলল, স্যার আমাকে আদর করে বলেছেন। আদর করে আমরা ভালো ভালো কথা বুলি।
তরিকুল ইসলামের স্ত্রী সালেহা বললেন, কেউ কেউ স্যারের মতো বলেন। ভিন গ্রামের এক ফকিরনী এসে তোকে দেখে রাজরানী রাজরানী বলে কত হইচই শুরু করল। মনে নাই?
আয়না বলল, বেশি ভিক্ষা পাওয়ার জন্য বলেছে মা। ফকিরনীরা খুব চালাক হয়। কী বললে কে খুশি হবে সেটা জানে!
মিসির আলি নিঃশব্দে নাশতা শেষ করলেন। চলে গেলেন নিজের ঘরের সামনের বাক্সান্দায়। চা-চঁটা আলাদা খাবেন। তার নিজের মাথা খানিকটা এলোমেলো লাগছে। এলোমেলো ভাবটা দূর করতে হবে। আয়না এল চা নিয়ে। তার সামনে বসল। মিসির আলি তাকালেন আয়নার দিকে। তাকে সাধারণ দেখাচ্ছে। গায়ের রঙ কালো। চাপা নাক। মোটা ঠোঁট। থুতনিতে আঁচিলের মতো আছে। থুতনির আঁচিল আগে লক্ষ করেন নি।
কোনো অর্থেই এই মেয়েকে রূপবতী বলা যাবে না। তা হলে সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গায়? দেখার ভুল? আলোছায়ার কোনো খেলা? প্রকৃতি নানান খেলা খেলে। আলোছায়ার খেলা তার একটি। তবে প্রকৃতি প্রশ্নের উর্ধ্বে না। তাকেও প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।
স্যার কি চিন্তা করছেন?
মিসির আলি হেসে বললেন, তেমন কিছু চিন্তা করছি না।
স্যার, আমার নামটা সুন্দর না? আয়না।
খুব সুন্দর নাম।
এই নাম কেন রাখা হয়েছে জানেন? ছোটবেলায় আমার খুব আয়নপ্রীতি ছিল। সারাক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখতাম। মনে করুন। আমি খুব কান্নাকাটি করছি। আমার হাতে একটা আয়না ধরিয়ে দিলেই আমি চুপ।।
মিসির আলি বললেন, আয়নপ্রীতি কি এখন নেই?
না। এখন আছে আয়নাভীতি। আমার ঘএর আয়না কালো পর্দায় ঢাকা। কতদিন যে আয়নায় নিজের মুখ দেখি না।
মিসির আলি বললেন, মনে হচ্ছে আয়না নাম তোমাকে পরে দেয়া হয়েছে। তোমার আসল নাম কী?
কুলসুম।
তোমার স্বামী তোমাকে কী নামে ডাকে? কুলসুম না আয়না?
সে কুলসুম নামের ল টা ফেলে দিয়ে কুসুম ডাকে। তবে বিয়ের কাবিননামায় আমার নাম কুলসুম থাকলেও আমি সিগনেচার করেছি ‘আয়না’ নাম।
আয়না তোমার খুব পছন্দের নাম?
জি।
তোমার রূপ সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? তুমি অতি রূপবতীদের একজন, না সাধারণ বাঙালি তরুণীদের একজন?
আয়না এই প্রশ্নের জবাব দিল না। হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে প্রশ্ন শুনে সে মজা পাচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, প্রশ্নটার জবাব দাও।
দিতেই হবে?
দিতে না চাইলে দেবে না। তোমার রূপ সম্পর্কে তোমার স্বামীর কী ধারণা?
আয়না নিচু গলায় বলল, বাসররাতে সে আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। ভোরবেলায় হতভম্ব। এখনো সে মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়। মাঝে মাঝে হতভম্ব হয়।
তাতে তুমি মজা পাও?
পাই।
এই মুহুর্তে আমি একটা সংখ্যা ভাবছি। সংখ্যাটা কত?
আট।
একটা পাখির কথা ভাবছি। পাখিটার নাম কী?
স্যার আপনি দুটা পাখির কথা ভাবছেন। একটা ঘুঘু আর একটা কোকিল। একটা কোকিল। গরমের সময় ডাকত। সে পাখিটা কেন হিমালয়ে যাচ্ছে না সেটা চিন্তা করছেন। এখন আবার অন্য একটা পাখির কথা ভাবছেন। হলুদ পাখি লম্বা লেজ। একা থাকে।
তুমি কি সবার চিন্তা বুঝতে পার?
পারি। কিন্তু বুঝার চেষ্টা করি না। মানুষের বেশিরভাগ চিন্তাই কুৎসিত।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝতে চাই তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?
আয়না বলল, স্যার সাহায্য করব। আমি নিজেও বুঝতে চাই। আপনার ছাত্রও বুঝতে চেষ্টা করেছিল। সে আমার বিষয়ে অনেক কিছু খাতায় লিখে রেখেছে। খাতাটা আমার কাছে। আপনি পড়তে চাইলে আপনাকে দেব। পড়তে চান?
চাই। তুমি নিজে কি তোমার বিষয়ে কিছু লিখেছি। ডায়েরি জাতীয় লেখা?
লিখেছি, তবে আপনাকে পড়তে দেব না।
তোমার স্বামীকে পড়তে দিয়েছিলে?
না। স্যার, আপনার আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। চা নিয়ে আসি? চায়ের সঙ্গে সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট তো তো আপনার সঙ্গে নেই। সিগারেট আনিয়ে দেই?
দাও।
কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট আনব?
মিসির আলি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট আনাবে তা তুমি জান। কেন জিজ্ঞেস করছ?
আয়না। হাসিমুখে উঠে গেল। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন নদীর দিকে। নদীর নাম রায়না। একসময় নাকি প্ৰমত্তা ছিল। স্টিমার যাওয়া আসা করত। এখন মরতে বসেছে। মৃত্যু সবার জন্যই ভয়ংকর।