তরিকুল ইসলাম বললেন, আরাম করে চা খান। নাশতার দেরি হবে ভাইসাব। নতুন চালের গুড়ি করা হচ্ছে। সেই চালের গুড়িতে পিঠা হবে। আগেরগুলো ফেলে দিতে হয়েছে।
মিসির আলি বললেন, আমার যে পিঠা খেতেই হবে তা কিন্তু না। আলু ভাজি দিয়ে পাতলা দুটা রুটিই আমার জন্য যথেষ্ট।
তরিকুল ইসলাম বললেন, ভাই সাহেব। আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আপনি আমার জামাইয়ের শিক্ষক। আপনাকে খাওয়াব আলু ভাজি রুটি? এরচে আমার গালে একটা থাপ্নড় মারেন।
মিসির আলি বললেন, ঠিক আছে। যা খাওয়াতে চান খাওয়ান।
দুপুরে চিতল মাছ খাওয়াব। বিলের চিতল। শীতকাল তো তেলে ভর্তি। আমার ছোটখালাকে খবর দিয়েছি। তিনি এসে রোধে দিয়ে যাবেন। আমার স্ত্রী রান্নাবান্নায় বড়ই আনাড়ি। একবার তের কেজির একটি বোয়াল মাছ এনেছিলাম এক পিস মুখে দিতে পারি নাই। এমন লবণ দিয়েছিল খেতে গিয়ে মনে হল নোনা ইলিশ।
আপনার মেয়ে রাধতে পারে না?
আয়নার কথা বলছেন? ওর তো ভাই মাথার ঠিক নাই! ও রাধবে কী? দুই তিন দিন একনাগাড়ে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকে। কিছু খায় না। পানিও না। তারপর দরজা খুলে বের হয়। খুব স্বাভাবিক।
গত দুদিন কি সে দরজা বন্ধ করে ছিল? হ্যা। তিন দিন ধরেই দরজা বন্ধ। হিসেব মতো আঞ্জ দরজা খোলার কথা। দরজা খুললেই আপনার কথা বলব।
মিসির আলির সামান্য খটকা লাগল। একটি মেয়ে তিন দিন দরজা বন্ধ করে আছে তার বাবা-মার এই কারণেই অস্থির থাকার কথা। তরিকুল ইসলামের বা তার স্ত্রীর চোখেমুখে কোনো অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে না। তঁরা দুজনই মেহমানের যত্ন নিয়ে অস্থির। এমনকি হতে পারে-মেয়ের পাগলামি দেখে দেখে তারা অভ্যস্ত। কোনো বাবা-মা”ই সন্তানের অস্বাভাবিকতায় অভ্যস্ত হবেন না।
মিসির আলি খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, হেডমাস্টার সাহেব! মেয়েটা কি আপনার নিজের না পালক কন্যা?
তরিকুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ভাই আপনার বুদ্ধি মারাত্মকেরও উপরে। মেয়েটা যে আমার নিজের না এই খবর কেউ জানে না। আমার জামাইও জানে না। জানানো উচিত ছিল, জানাই নাই। পালক কন্যা কেউ বিয়ে করে না। এমন ভালো পাত্ৰ হাতছাড়া হয়ে যাবে এই ভয়েই জানাই নি।
গ্রামের লোকদের তো জানার কথা।
কেউ জানে না। কেন জানে না সেটা একটা ইতিহাস। পরে আপনাকে বলব। ভাই সাহেব আমি পিঠার আয়োজন দেখি, আপনি চা খান।
হলুদ রঙের লম্বা লেজওয়ালা একটা পাখি ওড়াউড়ি করে শীত কাটাচ্ছে। পক্ষী সমাজে কেউ একা থাকে না। সবারই সঙ্গী থাকে। এই পাখিটা এক কেন? তার সঙ্গী কি কাছেই কোথাও বসে আছে। মিসির আলি হলুদ পাখির সঙ্গী খুঁজতে ঘাড় ফেরাতেই এক তরুণীকে দেখলেন। সে এসে মিসির আলির পা ছুঁয়ে কদমবুসি। করল। নরম গলায় বলল, স্যার আমি আয়না।
মেয়েটির পরনে সাধারণ একটু সুতি শাড়ি। প্রচণ্ড শীতে খালি পা। গায়ে চাদর নেই। মিসির আলি কিছু সময় মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটিকে এই পৃথিবীর মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে অন্য কোনো ভুবনের। পৃথিবীর কোনো মেয়ে এত রূপ নিয়ে জন্মায় না।
মিসির আলি বললেন, আয়না কেমন আছ?
ভালো আছি চাচা।
আমি তোমার স্বামীর একসময়কার শিক্ষক।
চাচা আমি জানি। অনেক আগেই আপনার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন ছিল। আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।
কোথায় আটকা পড়ে গিয়েছিলো?
আয়না হাসল, জবাব দিল না।
খালি পায়ে হাঁটছ। শীত লাগছে না?
শীত লাগছে। বাইরে এত ঠাণ্ডা বুঝতে পারি নি।
ঘরে যাও। পায়ে স্যান্ডেল, পর ৷ পায়ে চাদর দাও।
জি আচ্ছা চাচা। পরে আপনার সঙ্গে কথা হবে।
আয়না চলে যাচ্ছে। মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তিনি চোখ ফেরাতে পারছেন না। শীতের কুয়াশা ঢাকা সকাল। লম্বা লেজের হলুদ পাখি। কিন্নরীর মতো এক তরুণী। সব মিলিয়ে মিসির আলির মনে ঘোরের মতো তৈরি হল।
সকালের নাশতা তৈরি হয়েছে। শুধু ভাপা পিঠা না। পরোটা আছে। পরোটার সঙ্গে ঝাল মুরগির মাংস এবং ছিটা পিঠা। মিসির আলি সকালে মিষ্টি খেতে পারেন না। বাধ্য হয়ে অঁাকে পিঠা খেতে হচ্ছে। এত আয়োজন করে পিঠা তৈরি হয়েছে। খাবেন। না বলাটা অন্যায় হবে। মিসির আলির নিজেকে জাপানি জাপানি মনে হচ্ছে। জাপানির না বলতে পারে না। এমনই লাজুক জাতি। তবে সম্প্রতি একটা বই জাপান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের শিরোনাম-জাপানিরা এখন না বলা শিখেছে। বইটা জোগাড় করে পড়তে পারলে ভালো হতো।
ভাই সাহেব! পিঠা কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে। অসাধারণ।
আপনার খাওয়া দেখে তো সে রকম মনে হচ্ছে না। একটা পিঠা নিয়ে বসে আছেন। মিনিমাম তিনটা পিঠা শেষ করার পর পরোটা মাংস ৷
মিসির আলি খাদ্য আলোচনার মোড় ঘুরাবার জন্য বললেন, আপনার মেয়ে আয়নার সঙ্গে ভোরবেলায় দেখা হয়েছে। অতি রূপবতী মেয়ে।
তরিকুল ইসলাম বিক্ষিত গলায় বললেন, রূপবতী?
আমি এমন রূপবতী মেয়ে দেখি নি। গায়ের রঙ দুধে আলতায়।
মেয়েটা তো কালো।
কালো?
জি বেশ কালো।
তা হলে অন্য কাউকেই দেখেছি। কিংবা চোখে ভুল দেখেছি। কারণ মেয়েটা বলেছে সে আয়না।
কেউ কি আপনার সঙ্গে ফাজলামি করেছে? ফাজলামি কে করবে? ফাজলামি করার মতো মেয়ে তো এই গ্রামে নাই। আচ্ছা আমি দেখি আয়না ঘর থেকে বের হয়েছে কি না। বের হলো নিয়ে আসছি।
তরিকুল ইসলাম আয়নাকে নিয়ে ফিরলেন। কালো একটা মেয়ে। সাধারণ চেহারা! নাক মোটা। গালের হনু সামান্য উঁচু হয়ে আছে।