তরিকুল ইসলাম বললেন, তোকে তিন দিন কিছু খেতে না দিলে হাম হাম করে খাবি। যা দিবে। তাই খাবি।
আয়না বলল, তিন চার দিনতো আমি না খেয়ে থাকি।
তরিকুল ইসলাম চুপ করে গেলেন। কারণ ঘটনা সত্যি। আয়না। যখন তার ঘরে দরজা বন্ধ করে বাস করতে থাকে তখন সে কিছু খায় না।
মিসির আলি বারান্দায় বসেছেন বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টি হবার কারণেই হয়ত শীত কমে গেছে। মিসির আলির সামনে আয়না এবং ফারুক। মিসির আলি বললেন, তোমরা আগ্রহ নিয়ে বসেছি- আমি তোমাদের বিষয়ে কি বুঝলাম তা জানার জন্যে। আমি কিছুটা বিবৃতই বোধ করছি কারণ তেমন কিছু বুঝতে পারি নি। মানুষকে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নিজের জগতের বাইরের জগত সম্পর্কে জানার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। ম্যাথমেটিশিয়ানরা চার, পােচ, ছয় ডাইমেনশনের অংক বের করেছেন। সবই Abstract ব্যাপার। তারা বলছেন, আমাদের ত্রি মাত্রিক জগৎ হচ্ছে চার মাত্রার জগতের ছায়া। আবার চার মাত্রা হচ্ছে পাঁচ মাত্রার জগতের ছায়া। দারুণ জটিল ব্যাপার ছায়ার জগৎ।
আয়না বলল, আপনি যা বুঝেছেন। তাই বলুন। আয়না জগৎ কি আছে?
মিসির আলি হতাশ গলায় বললেন, আছে। তার প্রমাণ তোমার হাতের মুঠোয় রাখা কাগজ। সেখানে আমি লিখেছিলাম নদী, পাখি, ফুল। তুমি আয়না জগৎ থেকে বের হয়ে আসার পর লেখাগুলি হয়ে গেল উল্টা–mirror image-এই লেখা আয়নার সামনে না ধরলে পড়া যাবে না!
মজার ব্যাপার হচ্ছে ফারুক একটা দীর্ঘ চ্যাপ্টার এই ভাবে লিখেছে। যা সে লিখতে পারে না। ধরে নিচ্ছি। এই চ্যাপ্টারটা নিয়ে সে একবার আয়না জগতে ঢুকেছিল বলে লেখা mirror image হয়েছে। অবশ্যই ফারুক এমন একজন যার সঙ্গে আয়না জগতের যোগাযোগ আছে। ব্যাপারটা সে অতিযত্নে গোপন রেখেছে। আয়নার যে সব ক্ষমতা আছে তার সবই আমার এই ছাত্রের আছে। আমার যখন প্লুরিসি হলো একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলাম। কেউ তার ঠিকানা জানে না। ফারুক ঠিকই উপস্থিত হলো। আমি কিছুদিন পর পর বাসা বদল করি। নতুন ঠিকানা কাউকে জানাই না। ফারুক ঠিকই ঠিকানা জানে। সে চিঠি লিখেছে।
যে ছাত্রকে নামে চিনতে পারছি না তার একটা চিঠিতে আমি ঢাকা ছেড়ে ছাত্রের শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হব আমি সেই লোক না। ফারুক আমাকে প্রভাবিত করেছে। সে প্ৰাণপণ চেষ্টা করেছে রহস্য উদ্ধারের। আমার সাহায্য সেই কারণে নিয়েছে। সরি আমি সাহায্য করতে পারি নি।
তোমাদের জগৎ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। জানতে পারব তাও মনে হচ্ছে না। তবে তোমাদের দু’জনকেই আমি একটা উপদেশ দিচ্ছি। প্রকৃতি একই ধরনের দু’জনকে কাছাকাছি এনেছে। তার নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। তোমরা আলাদা হয়ে না। তার জন্যে তোমাদের যদি পুরোপুরি আয়না জগতে স্থায়ী হতে হয়- হবে। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই। Good luck.
মিসির আলি মাজেদকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। মিসির আলি প্ৰতি সন্ধ্যায়। তাকে পড়াতে বসেন। পাঠে তার প্রবল আগ্রহ।
ফারুক বা আয়নার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। তবে তিনি তরিকুল ইসলাম সাহেবের কাছ থেকে অদ্ভুত একটি চিঠি পেয়েছেন—
প্রিয় ভাইসাহেব,
আসসালাম। মহা বিপদে পড়িয়া আপনাকে পত্ৰ দিতেছি। আপনি যে দিবসে ঢাকা রওনা হয়েছেন সেই দিবসের রাতের কথা। খাবার খাওয়ার জন্যে আমার স্ত্রী মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে ডাকতে গেল। রান্না হয়েছে–সরপুটি ভাজা, কৈ মাছের (মিডিয়াম সাইজ) ঝোল এবং টেংরা মাছ (কোল ঝোল) কন্যার মা ফিরে এসে বললেন, ঘরে কেউ নাই। শুধু যে ঘরে কেউ নাই তা-না, বাহিরেও নাই। আমি অনুসন্ধানের বাকি রাখি নাই। জামাই গোপনে স্ত্রীকে নিয়া কর্মস্থলে চলে গেছে তাও সম্ভব না। রেল স্টেশন পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বাহন ছাড়া যাওয়া অসম্ভব। বাড়িতে রিকশা বা টেম্পে আসে নাই। আমি থানায় জিডি এন্ট্রি করিয়াছি। জামাইয়ের কলেজের প্রিসিপ্যাল সাহেবের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করিয়াছি তিনিও কিছু জানেন না। আমার নিজের ধারণা জীনভূতের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক আছে। জীন অনেক সময় পছন্দের ব্যক্তিকে তাহাদের দেশে নিয়া যায় এবং লালন পালন করে। আমি আমার মনের কথা কাউকে বলিতে পারিতেছি না। এখন মোবাইল টেলিফোনের জমানা। এই জমানায় কেউ জীন-ভূত বিশ্বাস করে না। ভাই সাহেব দয়া করিবেন যেন মহা বিপদ হইতে উদ্ধার পাই।
ইতি
তরিকুল ইসলাম
পুনশ্চ: মাশুল মাছের সন্ধানে আছি। পাওয়া মাত্র মোবাইল করিব। চলিয়া আসিবেন।
মিসির আলি বড় দেখে একটা আয়না কিনে নিজের শোবার ঘরে টানিয়ে রেখেছেন। তার ধারণা কোনো এক দিন আয়নায় ফারুক এবং তার স্ত্রীর দেখা পাওয়া যাবে। তাদের কোলে থাকবে অপূর্ব এক শিশু। শিশুটির দুষ্টমী ভর্তি চোখ দেখার তাঁর খুব শখ।