ফারুক বলল, স্যার কোয়ার্টার পাচ্ছিলাম না।
মিসির আলি বললেন, আগ্রহ থাকলে তুমি বাড়ি ভাড়া করতে। মেয়েটির সঙ্গে তুমি বাস করতে চাও না। আবার তাকে পুরোপুরি ছেড়েও দিতে চাও না।
ফারুক বলল, স্যার একটা জিনিস আপনার বুঝতে হবে- আয়নার অসাধারণ সাইকিক ক্ষমতার বিষয়টি আপনি জানেন। এ রকম একজন মহিলার সঙ্গে বাস করা অসম্ভব।
মিসির আলি বললেন, তুমি সাইকোলজির ছাত্র। একজন সাইকোলজির ছাত্রের সাইকিক ক্ষমতাধর স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। হয়ে গেল উল্টা।
ফারুক বলল, স্যার আয়না নিজেই কিন্তু বলছে সে আয়নার ভেতর ঢুকে যায়।
মিসির আলি বললেন, সে আদর্শ স্ত্রী’র মতো আচরণ করেছে। স্বামী যা চাচ্ছে তাই বলছে। সাইকোলজির ভাষায় এই ধরনের আচরণের একটা নাম আছে একে বলে Sympathetic delusion.
ফারুক বলল, এই হাইপোথিসিসটাকেই কি আপনি সমর্থন করছেন?
মিসির আলি বললেন, না। আমার সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা। এসো হিপনেটিজম শুরু হোক। ফারুক তুমি যদি আরেকটা সিগারেট খেতে চাও খেয়ে নাও। চোখ মুখ শক্ত করে রাখার কিছুই নেই। স্বাভাবিক হও। তোমাকে হিপনোটিক Trance এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে না। তুমি একজন Observer.
ফারুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আয়না স্বাভাবিক আছে। তার চোখে কৌতূহল। মিসির আলি বললেন, আয়না! আমি শুরু করব?
শুরু করুন।
আমি তোমাকে যা করতে বলব তুমি করবে। আমার উপর এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমি তোমার ক্ষতি করব না। তোমার অমঙ্গল হয় এমন কিছু করব না।
স্যার এই বিশ্বাস আমার আছে।
এখন তাকাও আমার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি আয়না জগতে ঢুকে যাবে। সেই জগৎ তোমার জন্যে আনন্দময়। সেখানে ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। ছায়া ছায়া অস্পষ্ট এক জগৎ। তুমি কি তৈরি?
জ্বি।
আয়না জগতে ঢুকে যাবার পর তোমাকে আমি প্রশ্ন করব তুমি উত্তর দেবে। সব প্রশ্নের উত্তর যে দিতে হবে তা-না। তুমি যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না চাও দেবে না।
মিসির আলি কাগজ কলম হাতে নিলেন। কাগজে লিখলেন- নদী, পাখি, ফুল। কাগজটা বলের মতো গুটি পাকিয়ে আয়নার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
আয়না। এই বলটা হাতের মুঠির মধ্যে নাও। এখন তুমি যাত্রা শুরু করেছ। আয়না জগতের দিকে। জগতটা মাটির নিচে। সিঁড়ি বানানো আছে। তুমি একেকটা সিঁড়ি পার হবে। আর আয়না জগতের কাছাকাছি যেতে থাকবে। তোমার এখন ঘুম পাচ্ছে। আয়না ঘুম পাচ্ছে?
পাচ্ছে।
প্রথম সিঁড়ি পার হলে। এইত দ্বিতীয় সিঁড়ি। আয়না! ঘুম পেলে চোখ বন্ধ করে ফেল।
আয়না চোখ বন্ধ করল। মিসির আলি বললেন, একটা সময় আমি বলব আয়না চলে এসো। তুমি আয়না জগত ছেড়ে চলে আসবে। আয়না শুনতে পাচ্ছ?
হুঁ।
তুমি তৃতীয় সিঁড়ি পার হয়েছ। এখন পার হলে চতুর্থ সিঁড়ি। আর একটা ধাপ শুধু বাকি। এই ধাপটা পার হলেই তুমি আয়না জগতে। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
অস্পষ্ট।
আয়না বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। সামান্য দুলছে। ফারুক নিজেও বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। সেও দুলছে। মিসির আলি নিশ্চিত আয়না জগতে আয়না একা ঢুকবে না। ফারুক নিজেও ঢুকে যাবে।
আয়না!
হুঁ।
এখন শেষ ধাপ পার হও। আয়না জগতে ঢুকে যাও।
আয়না দুলুনি বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। মিসির আলি ফারুকের দিকে তাকালেন। সেও মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে। মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। হাতে সময় আছে। তাড়াহুড়ার কিছু নেই।
আয়না আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
তুমি কোথায়?
আয়না জগতে।
তুমি একা না। আরো কেউ আছে তোমার সঙ্গে?
ও আছে।
ফারুক যে তোমার সঙ্গে আছে তোমার কি ভালো লাগছে?
লাগছে।
এখন আমি ফারুককে প্রশ্ন করব। ফারুক তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে?
পাচ্ছি।
তুমি কোথায়?
আয়না জগতে।
তোমার কি ভালো লাগছে?
না।
মিসির আলি বললেন, জগৎটা কেমন?
অন্য রকম।
ভয় লাগছে?
না।
এখানে থেকে যেতে চাও?
চাই।
আয়না জগতে এমন কি আছে যা এখানে নেই।
ফারুক থেমে থেমে বলল, আয়না জগৎ অন্য রকম জগৎ- চিন্তা এবং কল্পনার জগৎ।
মিসির আলির সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তিনি দ্বিতীয় সিগারেট ধরতে ধরতে বললেন, আয়না তোমাকে বলছি। ভালো আছে?
জ্বি স্যার।
আয়না জগতে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে?
হুঁ।
আশেপাশে তুমি কি দেখছ?
কিছুই দেখছি না। স্যার। শুধু ওকে আবছা আবছা দেখছি।
কিছুই দেখছি না কেন?
এই জগৎটা কুয়াশার। ঘন কুয়াশায় সব ঢাকা। হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশা বাতাসে সামান্য সরে যায়। তখন কিছু কিছু দেখা যায়।
কি দেখা যায়?
সেটা আমি বলব না।
দরজায় টোকা পড়ছে। তরিকুল ইসলামের গলা শোনা গেল। মিসির আলি সাহেব খাবার দেয়া হয়েছে। এমন গরুর মাংস খাবেন যে মৃত্যুর পরেও মনে থাকবে। গরম গরম খেতে হবে। চলে আসেন। কুইক। দুই মিনিট সময়।
মিসির আলি, আয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আয়নার ভেতর থেকে চলে এসো।
ওকে কি সঙ্গে করে নিয়ে আসব?
হ্যাঁ। ফারুক! তুমিও আস।
দু’জনের ঘোর এক সঙ্গে ভাঙল। তারা তাকালো মিসির আলির দিকে। মিসির আলি বললেন, আয়না! তোমার মুঠোয় যে কাগজটা আছে সেটা দাও। চল খেয়ে আসি। ডিনার টাইম।
রাতের খাবার শেষ হয়েছে। তরিকুল ইসলামের আনন্দের সীমা নেই। গরুর মাংস যতটা ভালো হবার কথা তারচেও ভালো হয়েছে। মিসির আলি খাবার ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে এই নিয়ে কখনো কিছু বলেন না। তিনিও বললেন, মাংসের টেস্টটা অদ্ভুত। তরিকুল ইসলাম, মিসির আলির প্লেটে মাংসের বাটি ঢেলে দিলেন। মিসির আলি তেমন আপত্তি করলেন না। আলোচনা খাবার নিয়ে চলতে লাগিল- কে কখন কি সুখাদ্য খেয়েছে সেই গল্প। জানা গেল তরিকুল ইসলামের সবচে পছন্দের খাবার শুকনা মরিচের ভর্তা। শুকনা মরিচের সঙ্গে একটা রসুন দিয়ে পাটায়। পিষে ভরতা তৈরি করতে হয়। খেতে হয় মাড় গলা ভাত দিয়ে। ফারুক বলল, তার পছন্দের কোনো খাবারই পছন্দ না। সে এমন এক জগতে থাকতে চায় যেখানে কাউকে কিছু খেতে হয় না।