এই দলটিকে ধ্বংস করার অনেক চেষ্টা করা হয়। কেউ পারে নি। অনেক পরে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান তাদেরকে পুরোপুরি ধ্বংস করেছিলেন।
গল্প শেষ করে মিসির আলি হাসলেন। আয়না বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার হাসছেন কেন?
মিসির আলি বললেন, তোমাকে ভ্ৰান্তির জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে একজন হালাকু খাঁ দরকার। আমি হালাকু খাঁ না। আমি বৃদ্ধ মিসির আলি।
ঘুম ভাঙ্গে ফজরের ওয়াক্তে
তরিকুল ইসলামের ঘুম ভাঙ্গে ফজরের ওয়াক্তে। তিনি হিমশীতল ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে নামাজ আদায় করেন। এরপর তার আর অনেকক্ষণ কিছুই করার থাকে না। বাড়ির সবাই ঘুমে। তাদের ঘুম এত সহজে ভাঙে না। তরিকুল ইসলাম ঝাড়ু হাতে নেন। উঠান ঝাড় দেয়া শুরু করেন। এতে দুটা কাজ হয়- উঠান হয় ঝকঝকে পরিষ্কার এবং তাঁর শীত কমে। কিছু এক্সসারসাইজও হয়। এই বয়সেও এক্সসারসাইজ করে শরীর ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।
একটা বিষয় চিন্তা করে তরিকুল ইসলাম বেশ মজা পান। বিষয়টা হচ্ছে বাড়ির কেউই উঠান বাট দেয়ার ব্যাপারটা জানে না। তারা ধরেই নিয়েছে ঘুম থেকে উঠে দেখবে চারদিক ঝকঝকি করছে। কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই।
তরিকুল ইসলাম উঠান ঝাঁট দিচ্ছেন। অর্ধেকের মতো ঝাঁট দেয়া হয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে এসে কে যেন তার হাত ঝাণ্টে ধরল এবং ঝাড়ু দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। তিনি চমকে পেছনে ফিরে আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। জামাই ফারুক এসেছে। তরিকুল ইসলাম বললেন, বাবা! কেমন আছ?
ফারুক কদমবুসি করতে করতে বলল, আপনি ঝাঁট দিচ্ছেন কেন? বাড়িতে মানুষ নাই?
তরিকুল ইসলাম বললেন, ঝাড়ু দেয়া মানে একই সঙ্গে হাতের, পায়ের এবং কোমড়ের এক্সসারসাইজ। এই জন্যে ঝাড়ু দেই।
ফারুক বলল, এক্সসারসাইজের জন্যে ঝাড়ু দিতে হবে না। আপনি ফ্রি হ্যান্ড এক্সসারসাইজ করবেন। বাবা এখন বলুন আমার স্যারের অবস্থা কি? উনি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন শুনে কি যে ভয় পেয়েছিলাম।
তোমার স্যার ভালো আছেন। ডাক্তার দেখে গেছে বলেছে কোনো ভয় নাই। উনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে মসজিদে একটা মিলাদও দিয়েছি। কবিরাজ রোহিনী বাবু এসেছিলেন তিনি চীবন প্রাস বানিয়ে দিয়েছেন। সকাল বিকাল এক চামচ করে খেলে ঘোড়ার মতো তেজি শরীর হবে।
স্যার কি ঘুমাচ্ছেন?
সবাই ঘুমাচ্ছে। কখন যে উঠবে আল্লাহ পাক জানে। দাঁড়াও ডেকে তুলি।
কে চা বানাবে?
আমি বানাব। আপনার জন্যে ইলিশ মিষ্টি নিয়ে এসেছি।
ইলিশ মিষ্টিটা কি?
সন্দেশ। ইলিশের পেটির মতো করে বানানো।
তরিকুল ইসলাম আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বের কর একটা খেয়ে দেখি। ভালো মিষ্টি দেশ থেকে উঠেই যাচ্ছে। নাটোরের কাচাগোল্লা এখন স্মৃতি ছাড়া কিছুই না। মেট্রিক পরীক্ষার আগের দিন নাটোরের কাঁচাগোল্লা খেয়েছিলাম। সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। হাতে লেগে আছে মিষ্টির গন্ধ। তোমরা এই জমানার ছেলে।পুলে আসল মিষ্টির স্বাদ কিছুই জানলে না। আফসোস, বিরাট আফসোস।
উঠানে বেতের মোড়ায় স্বশুর জামাই চা খাচ্ছেন। তিরিকুল ইসলাম আনন্দে অভিভূত। জামাইকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তাঁরকুল ইসলাম বললেন, দুপুরে মাছ কি খেতে চাও বল।
ফারুক বলল, বিলের ফ্রেস ছোট মাছ খাব।
পাঁচমিশালী গুড়ামাছ জোগার করব। কোনো সমস্যা নাই।
কালি বোয়াল কি পাওয়া যায় বাবা?
এইতো বিপদে ফেললে এইসব জিনিস কি আর দেশে আছে? দেখি চেষ্টা করে।
খলিসা মাছ?
আরেক ঝামেলায় ফেলেছ। খলিসাতো প্ৰায় extinct মাছ। এখুনি বের হচ্ছি। সকাল সকাল না গেলে পাওয়া যাবে না।
ফারুক বলল, বাবা আপনার জন্যে একটা চাদর এনেছিলাম। বের করে দেই? চাদরটা গায়ে দেন। দেব?
দাও।
তরিকুল ইসলাম গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে বললেন, আরেক কাপ চা বানাওঁ। চা খেয়ে বের হই। আরেকটা কথা বাবা তোমাকে বলি মন দিয়ে শোন। আমি শিক্ষক মানুষ তো সব মানুষকে আমার কাছে মনে হয়। পরীক্ষার খাতা। সবাইকে নম্বর দেই! তুমি আমার কাছে নম্বর পেয়েছ একশতে একানব্বই। সন্টার মার্কের চেয়েও বেশি। আর আমার জার্মান প্রবাসী গাধা পুত্র পেয়েছে চব্বিশ। গ্রেস মার্ক দিয়েও তাকে পাস করানোর বুদ্ধি নেই।
ফারুক বলল, আয়না। আয়না কত পেয়েছে?
তরিকুল ইসলাম চিন্তিত গলায় বললেন, ওর খাতাটা আমি বুঝি না। নাম্বারাও এই জন্যে দিতে পারি না।
আয়না দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি উঠোনের দিকে। শ্বশুর জামাই চা খেতে খেতে গল্প করছে দেখতে ভালো লাগছিল। এখন ফারুক একা। মাথা নিচু করে উঠোনে হাঁটছে। একবারও দোতলার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই আয়নার হাসি মুখ দেখতো।
আয়না দোতলা থেকে নামল। তার কেন জানি হঠাৎ ইচ্ছা করছে ফারুককে চমকে দিতে। নিঃশব্দে তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাউ’ করে চিৎকার দিলে কেমন হয়? আয়না খানিকটা অবাক হচ্ছে। এ রকম ইচ্ছাতো তার আগে কখনো হয় নি।
হাউ চিৎকার শুনে ফারুক চমকে তাকালো। আয়না গম্ভীর গলায় বলল, কেমন আছ?
ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
আমিও ভালো আছি। তোমার শিক্ষকও ভালো আছেন। তবে তাঁর মাথা খানিকটা এলোমেলো।
ফারুক বলল, আমার স্যার এমন একজন মানুষ যার মাথা কখনো এলেমেলো হয় না।
তাই বুঝি?
ফারুক বলল, হ্যাঁ তাই—
যদিও আমার গুরু শুড়ি বাড়ি যায়
তবুও আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
আয়না বলল, শুড়ি বাড়ি যায় মানে?
ফারুক বলল, কথার কথা বললাম, আমার গুরু কোথাও যান না।