পশুরা মানুষের চেয়ে বেশি ভয় পায়?
জ্বি স্যার। ওরা ভয়ংকর এক ভয়ের জগতে বাস করে।
তুমি ওদের মনের কথা বুঝতে পার?
না। ওদের মনে ভয়ের বাইরে তেমন কোনো আবেগও অবশ্যি নেই। অনেক মানুষের মনের কথাও আমি ধরতে পারি না।
কি ধরনের মানুষ।
নিম্ন শ্রেণির মানুষ। ওরা পশুর মতই। স্যার আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
চোখ বন্ধ করে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে।
তাহলে কথা বলুন।
তুমি কথা বল আমি শুনি।
আয়না বলল, আপনার ছাত্র প্রায়ই আমাকে বলত পৃথিবীটা মায়া ছাড়া কিছু না। পৃথিবী কি মায়া? আমাদের চারপাশে যা ঘটছে সবই মায়া?
মিসির আলি বললেন, সাধু সন্ন্যাসীরা এ রকম বলেন। এখন বিজ্ঞানীরাও বলছেন।
আয়না বলল, বুঝিয়ে বলবেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি আমার মাথার কাছে বসে আছ। আমি পঞ্চ ইন্দ্রীয় দিয়ে তোমার উপস্থিতি বুঝতে পারছি। চোখ দিয়ে দেখছি, তোমার গলার স্বর শুনছি, স্ত্ৰাণ পাচ্ছি এবং স্পর্শ করেও জানিছি। আমার ব্রেইন পঞ্চ ইন্দ্রীয় থেকে আসা signal কে ব্যাখ্যা করছে তোমার উপস্থিতি হিসেবে। সব signal ই কিন্তু electrical.
আয়না বলল, ব্ৰেইন তো সিগন্যাল পাচ্ছে যে আমি আছি তাহলে আমি মায়া হব কেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি স্বপ্ন দেখ না?
জি দেখি।
স্বপ্নেও ব্রেইন সিগন্যাল পায় বলেই দৃশ্য দেখে। আমরা কিন্তু স্বপ্নকে বলি মায়া।
হ্যাঁ বলি।
স্বপ্ন যদি মায়া হয় তাহলে জাগ্রত অবস্থায় যা দেখছি তাও মায়া। ঠিক না।
ঠিক।
আমরা পৃথিবী দেখি সাত রঙে। একটা গরু দেখে সাদাকালো। তাহলে তুমি বল আমাদের জগৎ কি রঙিন না। সাদাকালো?
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি।
এখন এই দাঁড়াচ্ছে না রঙের ব্যাপারটাও মায়া।
জ্বি।
তুমি নিজেকে অতি রূপবতী হিসেবে মাঝে মাঝে দেখাও। ব্রেইনের ইলিকট্রিক সিগন্যাল প্রভাবিত করে এটা কর। সেটাও মায়া। তেমন রূপবতী তুমি না।
স্যার ঘুমিয়ে পড়ুন।
মিসির আলি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। ডাক্তার চলে এসেছে। আয়না বলল, ডাক্তার সাহেব। আপনি অপেক্ষা করুন। বারান্দায় বসুন। চা খান। স্যার ঘুমাচ্ছেন। ঘুমের মধ্যে তাকে ডিসটার্ব না করাই ভালো।
মিসির আলি স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্নে আয়না মেয়েটি তার সঙ্গে কথা বলছে।
স্যার আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
হ্যাঁ চিনেছি। তুমি আয়না!
আমি কোথায় থাকি জানেন?
এখানেই থাক।
না। আমি থাকি আয়নার ভেতর মাঝে মাঝে আয়না থেকে বের হয়ে আসি।
ভালতো।
হ্যাঁ খুব ভালো। আমি যখন আয়নার ভেতর থাকি তখন খুব ভালো থাকি। ভালো থাকাটা জরুরি। আর কিছুই জরুরি না। আমি একটা মায়া का না নাद्ध?
হ্যাঁ। শুধু তুমি একা না, আমরা সবাই মায়া। একজন কেউ সেই মায়া তৈরি করেছেন।
স্যার কেন করেছেন?
আয়না আমি জানি না।
স্যার আমি এখন আয়নার ভেতর ঢুকে যাব। আর কেউ আমাকে পাবে না। আপনি ঘুমান।
মিসির আলি ঘুমুচ্ছেন। ঘুমের মধ্যে শুনছেন অনেক দূরে কোথাও অপূর্ব সংগীত হচ্ছে। এই সংগীত কি আয়নার ভেতর হচ্ছে?
মিসির আলির ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। তিনি এখন আছেন নিদ্রা এবং জাগরণের মাঝামাঝি। এই সময়টাও অদ্ভুত। তখন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে।
কেকুল নামের এক বিজ্ঞানী এই সময় স্বপ্ন দেখলেন একটা সাপ বার বার তার লেজ কামড়ে ধরছে এবং ছেড়ে দিচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন কেউ একজন তাকে বেনজিনের রিং স্ট্রাকচার বুঝিয়ে দিচ্ছে। তাঁর ঘুম ভাঙ্গল তিনি কাগজে বেনজিনের স্ট্রাকচার লিখলেন।
আরেক রাশিয়ার বিজ্ঞানী স্বপ্নে পেলেন পেরিওডিক টেবিল।
মিসির আলিও কি কিছু পাবেন? তিনি অস্পষ্ট গলায় ডাকলেন, আয়না। আয়না।
স্যার আমি আপনার পাশেই আছি।
তুমি আমার ছাত্রকে খবর পাঠাও সে যেন চলে আসে। আয়না বলল, আমি তাকে খবর পাঠিয়েছি।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমার রহস্যের সমাধান করতে চাচ্ছি।
তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? আমি একা পারছি না।
আয়না বলল, স্যার আমি সাহায্য করব।
ডাক্তার একজন না। দু’জন এসেছেন। একজন এমবিবিএস ডাক্তার আরেকজন হোমিওপ্যাথ। তরিকুল ইসলাম জানালেন, কবিরাজ রোহিনী বাবুকে খবর পাঠানো হয়েছে। উনিও চলে আসবেন। ত্রিমুখী চিকিৎসা হবে।
তার প্রেসার মাপা হলো, সুগার মাপা হলো— সবই নরম্যাল।
মিসির আলি বললেন, আমি খুব ভাল আছি। হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। এর বেশি কিছু না। আপনারা ব্যস্ত হবেন না।
হবে। একবার যার মাথা চক্কর দিয়েছে- আরো একবার দিতে পারে। আপনারা বিশ্রাম করেন। খাওয়া দাওয়া করেন। এমন পাবদা মাছ খাওয়াব মৃত্যুর সময় মনে হবে পৃথিবীতে কি জিনিস খেয়েছি। একেকটা পাবদা বোয়াল মাছের চেয়েও বড়। আপনারা বলেন মারহাবা।
দুই ডাক্তারই আনন্দিত গলায় বললেন, মারহাবা।
গরম চাদর গায়ে দিয়ে
রাত নটা।
মিসির আলি গরম চাদর গায়ে দিয়ে বারান্দায় বসেছেন। মাটির হাড়িতে তুষের আগুন করে তাঁর পায়ের কাছে রাখা হয়েছে যাতে তিনি পা গরম করতে পারেন। ফ্লাস্কে চা দেয়া হয়েছে। মিসির আলি পান খান না। তারপরেও পানের বাঁটায় পান দেয়া হয়েছে।
আয়না বসেছে তাঁর সামনে। সে গায়ে চাদর দেয় নি। সম্ভবত তার তেমন শীত লাগে না। আয়না বলল, স্যার একটা পান বানিয়ে দেই পান খান।
মিসির আলি বললেন, দাও।
আয়না পান বানাতে বানাতে বলল, আমাকে প্রশ্ন করলেই আমি উত্তর দেব। এইটুক সাহায্য আপনাকে করব। কিন্তু নিজ থেকে কিছু বলব না।