আয়নার গলা শুনতে পেলাম, সে বলল। এইতো আমার পাশে। আমার হাত ধর। আমি আয়নার হাত খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে স্পষ্টভাবে দেখছিও না। আবার বললাম, আমি কোথায়?
আয়না বলল, আমরা আয়নার ভেতর চলে এসেছি। এখন থেকে আয়নার ভেতর থাকব। ভালো হয়েছে কিনা?
উল্টো করে লেখা অংশের এখানেই সমাপ্তি। মিসির আলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। উল্টো লেখা দীর্ঘ সময় পড়ার কারণে তার মাথা খানিকটা জট পাকিয়ে গেছে। চারপাশের জগৎ দুলছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে মাথাকে সুস্থির হতে দিতে হবে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। এর মধ্যে ঢুকাল মাজেদ। মাজেদ বলল, স্যার ঘুম গেছেন?
মিসির আলি বললেন, না।
ঢাকায় কবে যামু স্যার?
আজই যাব।
আমার স্যান্ডেল?
কিনে দিব।
স্যার মাথা মালিশ কইরা দিমু?
না। এখন বিরক্ত করিস না। আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি।
চইলা যাব?
হ্যাঁ।
মাজেদ চলে গেল না। তার সামনে হাঁটাহঁটি করতে লাগল। মিসির আলি চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছেন সে এখন কোথায়? যদিও মাজেদ হাঁটছে নিঃশব্দে। এইতো সে এখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মিসির আলি চোখ মেললেন। মাজেদ ঘরে নেই। ঘর ফাকা। মস্তিষ্ক তাকে বিভ্ৰান্ত করেছে। মিসির আলি আবারো চোখ বন্ধ করলেন। এই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে কয়েকটা ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন দেখলেন। একটি স্বপ্নে বিশাল আয়নার ভেতর থেকে বাচ্চা মেয়ে বের হয়ে এল। স্বপ্নে সব কিছুই স্বাভাবিক মনে হয়। আয়নার ভেতর থেকে মেয়ে বের হয়ে আসার ঘটনাটা মিসির আলির কাছে স্বাভাবিক মনে হলো। বাচা মেয়েটি বলল, আমাকে চিনছেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি মার্থা।
আমি কোথায় থাকি জানেন?
জানি। আয়না জগতে।
আমাকে নিয়ে যে বইটি লিখেছে সেই বই আপনি পড়েছেন?
পড়েছি।
বইটার নাম বলুন।
বইটার নাম- Little girl from the mirror.
আমি যাই।
কোথায় যাবে?
যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাব।
মেয়েটি আয়নার ভেতর ঢুকে গেল।।
ঘুমন্ত মিসির আলিকে ডেকে তুললেন তরিকুল ইসলাম। তিনি বললেন, চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেন এটা কেমন কথা? ভাই সাহেব শরীরটা খারাপ?
মিসির আলি বললেন, শরীর ঠিক আছে।
আপনার শরীর মোটেই ঠিক না। শরীর ঠিক থাকলে কেউ চেয়ারে বসে ঘুমায় না। আসুন বিছানায় শুয়ে থাকবেন। মাজেদকে বলছি পায়ে তেল মালিশ করে দেবে। যে কোনো অসুখে পায়ে তেল মালিশ মহৌষধ।
ভাই আমি ভালো আছি। আপনি বললে তো হবে না। আমি বুঝতে পারছি সমস্যা আছে। হাত ধরি, উঠেন তো।
মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞান হারালেন।
জ্ঞান ফিরে দেখেন বিছানায় শুয়ে আছেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতেও তরিকুল ইসলাম পাখা দিয়ে প্ৰাণপণে হাওয়া করছেন। তরিকুল ইসলামের পাশেই তাঁর স্ত্রী চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। ভদ্রমহিলার হাতে পানির গ্লাস। মাজেদি সৰ্বশক্তি দিয়ে পায়ের পাতায় তেল ঘসে যাচ্ছে। শুধু আয়নাকে কোথাও দেখা গেল না। মিসির আলি বললেন, খুবই বিব্রত বোধ করছি। আপনাদের সবাইকে হঠাৎ চিস্তার মধ্যে ফেলে দিলাম। এখন আমি ভালো আছি। খুবই ভালো।
তরিকুল ইসলাম বললেন, কোনো কথা বলবেন না। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করবে। ডাক্তার আনতে লোক গেছে। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আপনি অজ্ঞান হয়ে আমার ঘাড়ে পড়লেন। কইলজাটা নড়ে গেল। ভেবেছি আপনি মারা গেছেন।
মিসির আলি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলেন।
তরিকুল ইসলাম বললেন, মন্দের মধ্যে একটা ভালো খবর শুনেন নবীনগর থেকে পাবদা মাছ নিয়ে এসেছে। আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলাম আজ এনেছে। খাওয়ার দরকার নাই এই মাছ চোখে দেখাও শান্তির ব্যাপার। একেকটা মাছের সাইজ বোয়াল মাছের কাছাকাছি। ঠিকমত রানতে পারব কি-না চিন্তায় অস্থীর হয়ে আছি।
তরিকুল ইসলাম সাহেবের স্ত্রী বললেন, মাছের কথা এখন বাদ থাকুক।
তরিকুল ইসলাম বললেন, বাদ থাকবে কি জন্যে? এত বড় পাবদা মাছ তুমি তোমার জন্মে দেখেছ? সেই মাছের গল্প করব না তো কি গল্প করব? তোমার বাপের বাড়ির গল্প করব? তোমার এক ভাই যে ঘুস খেয়ে জেলে গেছে সেই গল্পী?
এই সব কি কথা?
মিথ্যা বলেছি? মিথ্যা বললে মাটি খাই। আর যদি সত্যি বলে থাকি তুমি মাটি খাবে।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়ে পড়াই উত্তম।
ঘরে মনে হয় আয়না ঢুকেছে। মিষ্টি স্ত্ৰাণ পাওয়া যাচ্ছে। কদম ফুলের ঘ্রাণ। তরিকুল ইসলামের হৈচৈ থেমেছে। তাঁর স্ত্রী মনে হয় কাঁদছেন। কান্নার আওয়াজ আসছে।
আয়না বলল, বাবা-মা! তোমরা দু’জনই ঘর থেকে যাও। উনার ভালো ঘুম দরকার। আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমালেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি। উনার পাশে। মাজেদি তুমিও যাও। পায়ে তেল ঘষতে হবে না। তুমি যেভাবে তেল ঘষছ মনে হচ্ছে পায়ের চামড়া ঘষে তুলে ফেলবে।
মিসির আলি চোখ মেললেন। তরিকুল ইসলাম তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেছেন। মাজেদ চলে যাচ্ছে। আয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখন ইন্দ্রানীর মতো লাগছে। আয়না বলল, স্যার আমি আপনার কপালে হাত রেখে বসে। থাকিব। আপনার ভালো লাগবে।
আয়না। কপালে হাত রাখল। কি ঠাণ্ডা হাত। ঘুমে মিসির আলির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তিনি অ্যালস্য ও আরামের আশ্চর্য এক জগতে ঢুকছেন।
স্যার।
বল আয়না।
আপনার ছাত্র এসেছে। খবর পেয়েছেন?
পেয়েছি।
আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন শুনে সে কি যে ভয় পেয়েছে। এ রকম ভয় শুধু পশুরাই পায়। মানুষ পায় না।