এইসব আমার ছেলের করা। সে ইনঞ্জিনিয়ায়। জার্মানির এক ফার্মে কাজ করে। বাড়িঘর সব তার বানানো। তবে আপনার কাছে হাতজোড় করছি ছেলের কী নাম জিজ্ঞেস করবেন না। গত এপ্রিল মাসের সাত তারিখ থেকে এই বাড়িতে তার নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তার নাম উচ্চারণ করবে তার মুখ দর্শন করব না।
মিসির আলি বললেন, ছেলে এপ্রিল মাসের সাত তারিখ বিদেশী বিয়ে করেছে এই জন্য?
তরিকুল ইসলাম অবাক হয়ে বললেন, আপনার অসম্ভব বুদ্ধি। ঠিকই ধরেছেন। ইহুদি এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। কত বড় স্পর্ধা। দেশে থাকলে বাটা কোম্পানির জুতা দিয়ে পিটাতাম। আপশোঁস দেশে নাই। তার দেশে ফেরার উপায়ও নাই। আমি চিঠি লিখে জানিয়েছি-যেদিন সে আসবে সেদিন আমি এবং আমার স্ত্রী কাঁঠাল গাছে দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁস নেব।
মিসির আলিকে থাকার জন্য দোতলার বড় একটা ঘর দেয়া হয়েছে। ঘরের লাগোয়া দক্ষিণমুখী বারান্দা। বারান্দায় ইজিচেয়ার পাতা। বারান্দা থেকে দূরের নদী দেখা যায়। নদীর নাম রায়না। বারান্দা ঘেঁধে বিশাল এক কদম গাছ। গাছ ভর্তি বলের মতো ফুল। কদম বর্ষার ফুল। শীতকালে কদম গাছে শত শত ফুল ফুটবে ভাবাই যায় না। মিসির আলির ধারণা, গাছটার জিনে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। যে কারণে তার সময়ের টাইমটেবিল এলেমেলো হয়ে গেছে। অনেক পশু-পাখির ক্ষেত্রেই এরকম হয়। মিসির আলি যখন ঢাকার জিগাতলায় থাকতেন, তখন একটা কোকিল বৈশাখ-চৈত্র মাসে ডাকত। কোকিল৷ হিমালয় অঞ্চলের পাখি। বসন্তকালে দুডাকাডাকি করে গরমের সময় তার হিমালয় অঞ্চলে চলে যাবার কথা। সে থেকে গিয়েছে এবং তার অবস্থান জানানোর জন্য গরমকালে ডাকাডাকি করছে।
এই কদম গাছটাও হয়তো টাইমটেবিল নষ্ট হওয়া গাছ। অবিশ্যি এমনও হতে পারে যে এই কদম অন্য কোনো ভ্যারাইটির। আজকাল সামার ভ্যারাইটির টমেটো গাছ পাওয়া যাচ্ছে। টমেটো গরমকালে ফলে।
মিসির আলি রোজই ভাবেন হেডমাস্টার সাহেবকে কদম গাছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। মনে থাকে না।
হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে মিসির আলির কোনো পূর্ব পরিচয় নেই। তাঁর প্রিয় শহর ছেড়ে গ্রামের এই বাড়িতে থাকতে আসার কারণ এক পাতার একটা চিঠি। চিঠিটা তার ছাত্রের লেখা।
শ্রেদ্ধেয় স্যার,
আমার সালাম নিন। আমি আপনার সরাসরি ছাত্র। আপনি আপনার কোনো ছাত্রের নামই মনে রাখেন না। কাজেই নিজের পরিচয় দেয়া অর্থহীন। তারপরেও নাম বলছি। আমার নাম ফারুক। একটা সরকারি কলেজে সাইকোলজি পড়াই।
আপনি সারা জীবন অতিপ্রাকৃতের সন্ধান করেছেন। অবিশ্বাস্য সব ঘটনার বিশ্বাসযাগ্যো লৌকিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং আমাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন লজিক ব্যবহারে।
অন্যদের কথা জানি না, আমি চেষ্টা করেছি এবং এখনো করছি।
আমি আপনাকে ব্যাখ্যার অতীত কিছু ব্যাপারের সঙ্গে পরিচয় করাতে চাচ্ছি। হাতজোড় করছি কইলাটি ধর্মর একটা গ্রামের হেডমাস্টার তরিকুল ইসলাম সাহেবের বাড়িতে কয়েকটা দিন কাটাতে। উনি আমার শ্বশুর। সরল ধরনের মানুষ। কিন্তু খুবই ভালোমানুষ। তিনি কথা বেশি বলেন, এটা একটা বড় সমস্যা। আপনার মতো মানুষের কাছে এই সমস্যা কোনো সমস্যাই না। ঐ বাড়ির সমস্ত ঘটনা একটি তরুণীকে কেন্দ্র করে। তার নাম আয়না। আয়না আমার স্ত্রী। আমরা এখন আর একসঙ্গে বাস করছি না। আলাদা থাকছি। তবে আমাদের মধ্যে কোনো ডিভোর্স হয় নি। হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই। স্যার আপনি কি যাবেন? অল্প কিছু দিন থাকবেন। গ্রাম কইলাটি। পো: অ রোয়াইলবাড়ি। থানা কেন্দুয়া। জেলা নেত্রকোনা।
বিনীত
আহমেদ ফারুক।
কইলাটিতে দুদিন পার হয়েছে। আজ তৃতীয় দিনের শুরু। মিসির আলি কোনো অতিপ্রাকৃতের সন্ধান পান নি। কুয়াশায় ঢাকা গ্রাম। সন্ধ্যা হতেই মশার গুনগুন। গারো পাহাড় থেকে উড়ে আসা শীতের বাতাস। গরম মোজা, কানটুপি এবং ভারী চাদরও সেই হাওয়া আটকাতে পারে না। ঘুমুতে যাবার আগে আগে তরিকুল ইসলাম গরম পানি ভর্তি দুটা বোতল লেপের নিচে রেখে যান। তাতে ঠাণ্ডা লেপের ভেতর ঢোকার প্রক্রিয়া খানিকটা সহনীয় হয়।
তরিকুল ইসলাম যত্নের কোনো ত্রুটি করছেন না। রোজ রাতে ঘি চপচপ পােলাও খেতে হচ্ছে। মিসির আলি কয়েকবারই জানিয়েছেন পোলাও খাদ্যটি তার অপছন্দের। তিনি ডালভাত দলের মানুষ। তরিকুল ইসলাম চোখ কপালে তুলে বলেছেন, আপনি আমার জামাইয়ের শিক্ষক। আপনাকে ডালভাত খাওয়াব এটা কী বললেন?
ভাই আমি পোলাও খেতে পারি না। আমার পেটে সহ্য হয় না। ডাক্তারের নিষেধ আছে।
ডাক্তারের নিষেধ থাকলে কিছু করার নেই। পোলাওয়ের চালের ভাত করব। তবে সঙ্গে পোলাও থাকবে। শোভা হিসেবে থাকবে। চায়ের চামচে এক চামচ হলেও খাবেন।
মিসির আলি চায়ের চামচে এক চামচ করে পোলাও খেয়ে ভাত খাচ্ছেন। আদরকেও যে কেউ অত্যাচারে পরিণত করতে পারে, মিসির আলির এই অভিজ্ঞতা ছিল না।
সূর্য উঠেছে। সূর্যের প্রথম আলো গায়ে মাখতে ভালো লাগছে। তরিকুল ইসলাম চা দিয়ে গেছেন। এই চায়ের কাপও গ্লাসের মতো জাম্বো সাইজ। ঘন লিকারের দুধ চা। খেতে ভালো। চিনির পরিমাণ ঠিক আছে। ঐটা বিস্ময়কর ব্যাপার। গ্রামের মানুষরা চায়ে বেশি চিনি খেতে পছন্দ করে। চায়ের উপর ভাসন্ত সর থাকাকে তারা উত্তম চায়ের অনুষঙ্গ বিবেচনা করে।