আয়না বলল, মানুষ কারণে খুন করে। টাকা পয়সার জন্যে করে, শক্ৰতার জন্যে করে, আর এই লোকটা কারণ ছাড়া খুন করে।
আমি বললাম, মনগড়া কথা কখনো বলবে না। মুকসেদের মতো শান্ত, নরম এবং ভদ্রছেলে আমি কখনো দেখিনি।
আয়না বলল, সে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, পুলিশ তাকে খুঁজছে।
আমি বললাম, টেলিপ্যাথির মাধ্যমে সব জেনে ফেলেছ? না-কি স্বপ্নে জেনেছ?
আয়না বলল, কি ভাবে জেনেছি। আমি জানি না। তবে জেনেছি। প্রফেসর সাহেব ঐ খুনিটার দুলাভাই না। তিনি সব জেনেশুনে খুনিটাকে আশ্রয় দিয়েছেন। খুনিটার নাম মুকাসেদ না। তার নাম কামাল।
যাদের খুন করেছে তাদের নাম কি?
মেয়েটার নাম বলতে পারি। তার নাম শিউলি। মেয়েটাকে প্ৰথম সে পাট ক্ষেতে টেনে নিয়ে গিয়ে রেপ করেছে তারপর খুন করেছে।
আমি তাকিয়ে আছি। আয়নার উদ্ভট কথাবাতাঁর কোনো অর্থ করতে পারছি না। এটা কি প্যারানিয়া?
আয়না বলল, তুমি কি থানার ওসি সাহেবকে বলবে যে কামাল এখানে লুকিয়ে আছে।
আমি বললাম, উদ্ভট কথাবার্তা বলবে না। কোনো কারণ ছাড়া আমি ওসি সাহেবকে বলব যে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একজন খুনি ঘাপটি মেরে আছে?
আয়না ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাক বলতে হবে না। যা হবার আপনাতেই হবে। কয়েকদিন আগে আর পরে। খুনিটার ফাঁসি হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে-ফাঁসির দড়িতে ঝুলেও সে কিন্তু মরবে না। দীর্ঘ সময় ঝুলন্ত অবস্থায় বেঁচে থাকবে এবং চোখের সামনে ভয়ংকর সব দৃশ্য দেখবে। তার কাছে মনে হবে সে অনন্তকাল এইসব দৃশ্য দেখছে।
আমি বললাম, তুমি তার ভবিষ্যত চোখের সামনে দেখে ফেলেছ?
আয়না হাসল আর কিছু বলল।
আয়নার সঙ্গে খুনি মুকাসেদ বিষয়ে কথাবার্তা বলার দ্বিতীয় দিনে পুলিশ এসে মুকসেদ এবং প্রফেসর জালাল সাহেবকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। আমি প্রিন্সিপ্যাল সাহেব এবং চারজন শিক্ষককে নিয়ে থানায় ছুটে গোলাম। জালাল সাহেবকে অ্যারেস্ট করেছে। একজন সিনিয়র শিক্ষক। ওসি সাহেব বললেন, এই ভয়ংকর খুনী এখানে লুকিয়ে আছে আমরা জানতাম না। কিভাবে টের পেলাম সেই ইতিহাস আপনাদের বলতেই হবে। জগতে কত রহস্য যে আছে। ঘটনা হয়েছে কি— শরীরটা খারাপ লাগছিল। আমি থানা থেকে দুপুর বেলা বাসায় গেলাম। খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছি হঠাৎ স্বপ্নে দেখি অতি অপরূপ এক মেয়ে আমাকে বলছে- ওসি সাহেব! ঘুম থেকে উঠুন। ভয়ংকর খুনি কামাল কোথায় আছে আমি জানি। এই হলো ঠিকানা। সে ঠিকানা বলল। একবার না, কয়েকবার।
আমার ঘুম ভাঙল। ইউনিফর্ম পারলাম। আর্মড পুলিশ নিয়ে ফ্ল্যাট ঘেরাও করলাম। হারামজাদাটাকে পেয়ে গেলাম।
আমার স্ত্রী যে অস্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়ে এসেছে এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ কখনোই ছিল না। ক্ষমতার ব্যাপ্তিটা কতটুকু তা ধরতে পারছিলাম না। প্যারা নরমাল জগতে সাইকিক ক্ষমতা সম্পন্ন অনেক মানুষের উদাহরণ আছে। ডকুমেন্টেড সব ঘটনা। রাশিয়ার এস বেলায়েভ নামের একজন শৌখিন চিত্রকর পদার্থবিদদের সামনে তিন মিনিট লেভিটেসনে ছিলেন। মেঝে থেকে এক ফুট উঁচুতে ভেসে মাধ্যকর্ষণ শক্তিকে কাঁচকলা দেখিয়েছেন। সায়েন্টিস্টরা কিছুই ধরতে পারেন নি।
ইসরায়েলের য়ুরি গেলার চোখের দৃষ্টিতে চামচ বাঁকা করতে পারতেন। ম্যাজিশিয়ানরা দাবি করেন এখানে কিছু ম্যাজিকের কৌশল আছে। য়ুরি গেলার বিবিসি টেলিভিশনে চামচ বাঁকানো দেখালেন।
তাকে ঘিরে রইল সায়েনটিস্ট এবং ম্যাজিশিয়ান। কেউ কিছু ধরতে পারল না।
আমেরিকার ABC টেলিভিশন মার্থা নামের আট বছর বয়েসী একটি মেয়েকে নিয়ে এক ঘন্টার প্রোগ্রাম করেছিল। সে যে কোনো মানুষের দিকে তাকিয়ে মানুষটা কি ভাবছে বলতে পারত। এই মেয়েটি অদ্ভুত একটা কথা বলত। সে বলত মানুষের মনের কথা বুঝার ব্যাপারটায় তাকে আয়না সাহায্য করে। ঘরে আয়না না থাকলে সে কিছু বলতে পারে না। সে বলত পৃথিবীতে যেমন একটা জগৎ আছে। আয়নার ভেতরেও একটা জগত আছে। আয়নার মানুষরা পৃথিবীর মানুষের মতোই তবে তাদের অনেক ক্ষমতা। আয়নার ভেতরের জগতে কোনো পাপ নেই। পৃথিবীতে পাপ আছে।
মার্থাকে জিজ্ঞেস করা হলো—পাপ কি?
উত্তরে মার্থা ভুরু কঁচকে বলল, পাপ হচ্ছে ঈশ্বরের অন্ধকার (Dark side of God)
আমার স্ত্রী আয়না কি মার্থার কথার আয়না জগতের কোনো মানবী? আমি তার উত্তর জানি না। তবে আঙুরের মতো আমিও এক রাতে আমার স্ত্রীকে আয়নার ভেতর ঢুকে যেতে দেখলাম। ঘটনাটা এ রকম—
আয়না তার ঘরে বসেছিল। তার সামনে বড় একটা আয়না। সে এক দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দূর থেকে তাকে দেখছি। আমার দিকে সে পেছন ফিরে আছে বলে আমাকে দেখছে মা! আমি দেখলাম। সে আয়না কাছে টেনে নিল। আয়নায় চুমু খেল এবং চলে গেল আয়নার ভেতর। ব্যাপারটা এত সহজে ঘটল যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। আমার মনে হলো আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। আমি কোনো রকমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
কি আশ্চর্য! বারান্দায় আয়না হাঁটুর উপর মাথা রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বাসা। সে আমাকে দেখে বলল, কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো কারণে কি ভয় পেয়েছ?
আমি উত্তর দিলাম না। এক ত তার দিকে তাকিয়ে আছি। আয়না বলল, বোস। এখানে।
আমি বসলাম আর তখনি মনে হলো আমার সামনের জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে। চোখে স্পষ্ট কিছুই দেখছি না। চলে গেছি। অন্য কোনো ভুবনে। সেই ভুবনের আলো নরম। সব কিছু ছায়া ছায়া অস্পষ্ট। আমি বললাম, কোথায় আছি?